Header Ads

মধ্যরাতের বিভ্রান্তি! আমি যখন ঘর থেকে বের হচ্ছি তখন মাথার ওপর ভরা জোছনা। এ রকম চাঁদের আলোয়

 মধ্যরাতের বিভ্রান্তি!

আমি যখন ঘর থেকে বের হচ্ছি তখন মাথার ওপর ভরা জোছনা। এ রকম চাঁদের আলোয় মানুষের ছায়া পড়ে আর মানুষ তাতে বিভ্রান্ত হয়। আমি মোটামুটি বিভ্রান্তের মতো রিকশায় উঠে বসি।


বাসস্টেশনে এসে দেখি হাতে জ্বলন্ত মশার কয়েল নিয়ে এক লোক নূরের পেছনে পেছনে হাঁটছে। আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করি, ‘এই আজব লোককে কোত্থেকে জোগাড় করলে?’


নূর হাসে, ‘যাদের ঘর আছে মশা তাদের কামড়ায়, যাদের ঘর নাই মশা তাদেরকেও কামড়ায়!


‘মশার কাছে মানুষের কোনো বাছবিচার নেই, সবাই সমান। এই লোক রাস্তায় ঘুমায়, কিন্তু মশার কামড়ে নাকি ঘুম আসে না, তাই সব সময় মশার কয়েল নিয়ে ঘোরে।’


লোকটা নূরের কথায় অত্যন্ত আনন্দিত হয়। তারপর হাসতে হাসতে বলে, ‘ভাইজান, যদি একটা চা খাওয়াইতেন।’


আমি দোকানদারকে তিন কাপ চা দিতে বলি। লোকটা আবার হাসে, ‘যদি একটা কেক খাওয়াইতেন।’


আমি দোকানদারকে বলি, ‘উনাকে একটা কেক দেন।’

লোকটা আরও উৎসাহিত হয়ে বলে, ‘যদি একটা কলা খাওয়াইতেন।’


নূর লোকটাকে ধমকিয়ে ওঠে, ‘কলা খেলে রাতে ঘুম আসবে না। তাড়াতাড়ি চা-কেক খেয়ে জায়গা দখল করেন, না হলে অন্য কেউ এসে আপনার জায়গা দখল করে ফেলবে। দেশে এখন জায়গার খুব দাম!’


নূর আমার দিকে তাকিয়ে গোপন কোনো আলাপের মতো ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ঘটনা কী বল তো? হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, টেকনাফ যাওয়ার দরকার হলো কেন?’


আমি রহস্য করে বলি, ‘একটা ফুল আনতে যাচ্ছি।’

নূর আমার কথায় ভীষণ অবাক হয়, ‘একটা ফুল আনতে এত দূর! তোমার মাথা খারাপ হলো নাকি!’


আমি আবারও হেঁয়ালি করি, ‘পৃথিবীর কোনো প্রেমিকের মাথা কখনো ঠিক ছিল না! যারা একবার প্রেমে পড়েছে তাদের সবার মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে!’


নূর আমার রসিকতা ধরতে পারে না, ‘কী হয়েছে খুলে বল তো। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’


আমি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলি, ‘সুনন্দাকে বলেছিলাম, তোমাকে কিছু একটা দিতে চাই। সুনন্দা আমার হাতটা ধরে রেখে বলেছিল, তুমি আমার সাথে আছ এটাই তো আমার সবকিছু, আর কিছু চাই না। আমি অনেক জোরাজুরি করাতে সুনন্দা মুচকি হেসে বলল, যে জিনিসটা চাইব সেটা খুবই সহজলভ্য আবার খুব দুষ্প্রাপ্য। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বঙ্গোপসাগরের কোনো এক দ্বীপে একটা ফুল পাওয়া যায়, বছরে একবার ফোটে। সেটা নামে ফুল হলেও দেখতে ফলের মতো। পারলে আমার জন্য সেই ফুল একটা এনে দিয়ো।’


নূর বিস্ময়ে কথা বলতে পারে না। অনেকক্ষণ পরে তার সংবিৎ ফেরে, ‘তাহলে আমি কী দোষ করলাম ভাই! আমাকে সাথে নেওয়ার কারণ কী?’


আমি এবার হেসে ফেলি, ‘তুমি হারানো মানুষ খুঁজে পাওয়াতে ওস্তাদ। এবার না হয় আমার জন্য একটা হারানো ফুল খুঁজে দেবে। কারও কারও জন্য তো একটা ফুল একটা মানুষের জীবনের সমান।’


নূর কিছু বলে না। আমি ভয়ে ভয়ে বলি, ‘আমরা নাফ নদী দিয়ে বঙ্গোপসাগরে বের হয়ে যাব। তারপর ছোট ছোট দ্বীপগুলোতে ফুলটা খুঁজব।’


আমি নূরের ধমক খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করি। নূর মুখ কালো করে বলে, ‘বাস ছাড়তে এখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। চল, কর্ণফুলীর পাড় থেকে ঘুরে আসি। নোঙর করে থাকা জাহাজ আর মাছ ধরার ট্রলারে লাল-নীল বাতি জ্বলে। দেখে মনে হয় একঝাঁক তারা নিয়ে আকাশটা নদীতে নেমে এসেছে।’


কর্ণফুলীর পাড়ে এসে আমি অবাক হয়ে গেলাম। জোছনায় নদীটাকে অপার্থিব লাগছে। নূর রহস্যময় গলায় বলে, ‘অনেক বছর আগে আমার পূর্বপুরুষ এই নদীর ওপর দিয়ে সাম্পানে করে রেঙ্গুন শহরে গিয়েছিল বাণিজ্য করতে।’


আমি রসিকতা করি, ‘আবদুল গফুর হালী সে জন্যই তো গান লিখেছিলেন, “বানু রে, অ বানু, আঁই যাইয়ুম রেঙ্গুন শহর, তোঁয়ারলাই আইননুম কী”?’


নূর আমার কথায় কান দেয় না। আমি দেখতে পাই জোছনার আলো নূরের গালের ওপর চকচক করছে। অবাক হয়ে বলি, ‘তুমি কাঁদছ নাকি!’


নূরের গলা বুজে আসে, ‘অথচ দেখ আজকে হাজার হাজার মানুষ একটু আশ্রয়ের খোঁজে, একটু খাবারের জন্য নাফ নদী পার হয়ে এ দেশে আসতে চাইছে।’


আমার হঠাৎ করে বাসস্টেশনে মশার কয়েল হাতে নিয়ে ঘোরা লোকটার কথা মনে হলো। একটু মাথা গোঁজার জন্য, একটু খাবারের জন্য সারা পৃথিবীতেই এ রকম লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আমার খুব মন খারাপ হয়, ‘আসলে গৃহহীন মানুষের কোনো দেশ নেই।’



আমার আর কিছু ভালো লাগে না। নূরকে বলি, ‘চল, বাসায় চলে যাব। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।’


নূর অবাক হয়, ‘ফুল আনতে যাবে না?’


আমার বিষণ্নতা কাটে না, ‘আমি যদি ফুল নিয়ে আসার সময় নাফ নদী পাড়ি দিয়ে আসা লোকগুলোর সামনে কিংবা মশার কয়েল হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো লোকটার সামনে পড়ে যাই, তাহলে লজ্জায় তো আমার মরে যেতে ইচ্ছে করবে। আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান যে আমার অন্তত মাথার ওপর ছাদ খুঁজে বেড়াতে হচ্ছে না।’


নূর নাছোড়বান্দা, ‘কিন্তু, সুনন্দা রাগ করবে না?’

আমি হেসে ফেলি, ‘সুনন্দা তো বলেই দিয়েছে, আমি সারা জীবন তার হাত ধরে থাকলে সে তাতেই খুশি। তার আর কিছু চাই না।’


আমি রিকশায় করে যখন বাসায় ফিরে যাচ্ছি তখন জোছনা আরও ঘন হয়ে এসেছে। এ রকম জোছনায় খুব প্রিয় কারও হাত ধরে সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আমি সুনন্দার বাসার সামনে চলে যাব কি না ভাবছি। এ রকম জোছনায় কেউ বেশিক্ষণ ঘরের ভেতরে থাকতে পারবে না। কখনো না কখনো তাকে বারান্দায় আসতেই হবে। সে দেখবে অনেক দূরে একটি ছেলে ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীর মতো একা বসে একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। জোছনায় ছেলেটির ছায়া পড়েছে রাস্তায়। তারপর একবার ছেলেটির দিকে, আরেকবার তার ছায়ার দিকে তাকাতে তাকাতে পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে যাবে সে।


Romantic story

Romantic Story 

No comments

Powered by Blogger.