Header Ads

রয়ে যাওয়া ভালোবাসা

 রয়ে যাওয়া ভালোবাসা

.....................................

অপু আহমেদ এলিয়েন

.....................................



> কিরে কেমন আছিস তুই....?? কী করছিস.?? (বিপাশা)


>> কেমন আছিস মানে কী.?? নিজের স্বামীকে কেউ তুই করে বলে..। আবার কোনো সালাম ও নেই....??(আমি)


> তুই আমার স্বামী...। আর তোকে আপনি করে বলবো.??


>>তাতো অবশ্যই...।।


এসে আমার কান টেনে ধরলো,


> জানিস আমি তোর কয় দিনের বড়.?


>> হুম জানি..!!! দুই বছরের..।


> তাহলে তুই আমার স্বামী হবি। তাই না..?? কানের নিচে দুইটা দিলে সব ভূত ঘাড় থেকে নেমে যাবে..??


>> তুমি জানো না..। ভালোবাসা কোনো বয়স মানে না।


> হইছে আমায় জ্ঞান দিতে আসবি না..। আর আমি আন্টিকে তোর এই আকাশ-কুসুম কল্পনার কথা বলবো।


>> আম্মু জানে যে ভবিষ্যতে তুমি আমার বউ হবে..? তাই বলেও কোনো লাভ নাই...।।


> দাঁড়া তোর ভূতটা নামানোর ব্যবস্থা করছি...।।


>> ভূতটা কিছুদিন পরে তোমার ঘাড়ে চাপবে।


> ধূর..। তোকে একটা ব্যবস্থা করতেই হবে...?


এই বলে রেগে-মেগে চলে গেলাে। চলে যেতেই আমি উচ্ছস্বরে হেঁসে উঠলাম...।


আম্মুর বান্ধবীর মেয়ে বিপাশা ছিদ্দিকা। আমার চেয়ে দুই বছরের বড়...। তাই বলে সবসময় আমাকে তুই তুই করে ডাকবে কেন.?? তুমি করে বললে কী হয়.?? কিন্তু উল্টো ওকে সম্মান দিয়ে আপু বলতে হবে..। উনার কথা। উনি মানে বিপাশা..।


ও চলে যেতেই খুব হাঁসলাম.. । রাগতে তাকে বেশ দেখায় বেশ লাগে....।। যখন রেগে গাল গুলা ফুলিয়ে বসে থাকে মনে হয় গালে আলতো করে ছুঁয়ে দিই। কিন্তু তা কোনো ভাবে সাহস হয় না..।। যখন বিস্ফোরিত হতে শুরু করে তখন তো কোনো কথা বলাই দায়...।। অন্য সবার সাথে কতো ভালো ভাবে হেঁসে কথা বলে আর আমার সাথেই কেবল উনার বড়গিরি, গার্জিয়ান হয়ে হয়ে উঠেন..।। যাইহোক তারপরেও নিজের প্রিয় মানুষ।


হঠাৎ আম্মু ডাক দিলেন......।। আমি আম্মুর কাছে গেলাম..। গিয়ে দেখি আম্মুর বান্ধবী মানে রোকেয়া আন্টি বসে আম্মুর সাথে গল্প করছেন...। আমি কাছে যেতেই সালাম দিলাম...। উনিও আমাকে হাঁসিমুখে সালামের উওর দিয়ে পড়া-শোনার খবর কেমন এইসব জিজ্ঞাসা করলেন...। অনেক্ষণ বসে থাকার পরে আম্মু আর আন্টি তারা দু'জনেই গল্পতে ব্যস্ত হয়ে গেলো..। আমি উঠে নিজের রুমে চলে আসছিলাম..।একটু বাইরে যাওয়া দরকার..। আম্মু আবার ডাক দিলেন,


-- অপু একটু শোন..??


-- হুম বলো...।


-- আজ থেকে তিন মাস বিপাশা আমাদের এখানে থাকবে। তার ফাইনাল এক্সাম-এর জন্যে..।


-- আচ্ছা। ঠিক আছে..।


-- আর শোন ওকে সাথে করে প্রতিদিন দিয়ে আসবি আর নিয়ে আসতে হবে....।


-- ঠিক আছে আম্মু, তুমি যা বলবে..।


আমার যে কী পরিমান আনন্দ বলে বোঝানো যাবে না...!!! তাই খুশিটা নিজের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে তাড়াতাড়ি আম্মুর সামনে থেকে সরে গেলাম.


পরের দিন ভোর বেলা...


-- এই তাড়াতাড়ি উঠ..। কলেজ নিয়ে যাবি....?


-- যাও পারবো না..। আমি ঘুমাবো..।


এই বলে আমি ব্ল্যাঙ্কেট দিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়লাম..।


-- আমি গেলাম আন্টিকে বলতে...। যে তুই আমাকে নিয়ে যাবি না কলেজ-এ..।


-- এইই্ই্..। না না আমি নিয়ে যাচ্ছি বলিস না আম্মুকে...।


-- হুম। তাড়াতাড়ি উঠ। সময় কম আছে হাতে..।


-- উঠছি তো..। একটু আদর করে বললে হয় না..। মিষ্টি করে ডাকলে কী হয়.??


-- ঐ কিছু বললি.??


-- না কিছু না..।


-- হুম। তাড়তাড়ি আয়...।


এই বলে চলে গেলো.। এই মেয়ে যদি আমার জীবনে আসে জীবনটা তো একবারে স্বাদহীন হয়ে যাবে। ধ্যাত..। কী ভাবছি এসব.। হোক না যেরকম-ই, ওকেই শুধু চাই.।।


ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম..। দেখি ও রুম থেকে বের হলো সেঁজেগুঁজে..। আমি তো ওকে দেখে পলক ফেলতে ভূলে গেছি মনে হয়...।। ও কাছে এসে বললো,


-- "ঐ যাবি না নাকি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি...??"


-- হ্যাঁ, তাইতো। চলো...!!


রাস্তায় বের হয়ে কিছুক্ষণ হাঁটলাম..। সামনে থেকে রিক্সা নিবো..। আমি যেই বললাম,


-- চলো রিক্সায় করে যায়...।


-- তোর সাথে...!!!


-- কেন.? আমার সাথে গেলে কী ক্ষতি হবে শুনি...??


-- না তোর সাথে এক রিক্সায় যাবো না...।


-- কেন.?? আমি আবার কী করলাম..??


-- তোর সাথে হেঁটে কথা বলতে বলতে যাবো...।


-- বাব্বাহ্...!!! আমার সিনিয়র বউটা দেখি অনেক রোমান্টিক হচ্ছে দিনে দিনে..।


আস্তে আস্তে বললাম। শুনলে তো আর নিস্তার নেই।


-- আমায় কিছু বললি...।


-- নাহ্..!! কিছু বলিনি তো...।


-- গুড। একটা রিক্সা ডেকে আন...।


-- হুম.. ।


একটু রোমান্টিক করে বলা যান না...।। কিছুদিন পরেই তো.....।।


ওসব কিছু মাথা থেকে ঝেড়ে একটা রিক্সা নিয়ে আসলাম। আমি রিক্সা নিয়ে এসে আমি নেমে দাঁড়িয়ে রইলাম। আর বিপাশা রিক্সার বাম পাশে উঠে বসলো। যদিও জোরে নাম ধরে ডাকি না। কিংবা সামনে থাকলেও নাম ধরে ডাকি না। ও রিক্সাতে বসে আমাকে বললো,


-- কীরে তুই রিক্সাতে উঠছিস না কেন.?


-- আমি !


খুব অবাক হলাম আমি। আমাকে তার সাথে রিক্সায় উঠতে বলছে।


-- আমি কী ? তাড়াতাড়ি আয়। স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে পরীক্ষক আর রুমে ঢোকতে দিবে না।


-- হুম।


আমি উঠে বসলাম রিক্সাতে। রিক্সা চলতে শুরু করলো। কিন্তু আমি আনইজি ফিল করতে লাগলাম। কোনো ভাবেই স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করছিলাম না। কখনো তো এমন হয় নি। আর রিক্সাতে যে প্রথম উঠেছি তা নয়। ফ্রেন্ডসদের সাথে একরিক্সাতে চারজন ও উঠেছি। কিন্তু এমন কখনো অনুভব হয় নি। আমি একটু একটু ঘামতে লাগলাম। হঠাৎ বিপাশা বলে উঠলো,


-- এই অপু রিক্সা থেকে নাম ?(বিপাশা)


আমাকে একটা ধাক্কা দিলো। আমি হকচকিয়ে উঠলাম।


-- কী হয়েছে আপু ? (আমি)


আপু বলেই ডাকি সবার সামনে। না হলে সবার সামনে শাস্তি দিতে পারে। আবার তুমিও বলি। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় নাম ধরে ডাকতে। কিন্তু প্রচন্ড রাগী। তাই চাইলেও সম্ভব হয় না।


-- নামবি নাকি বসেই থাকবি ? চলে এসেছি তো ?


-- হ্যাঁ। নামো।


-- কই হারিয়েছিলি ?


-- কোথাও না। চল তোমার পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে।


নিজের ভেতরের দুর্বলতা বুঝতে না দিয়ে পরীক্ষার হলে দিয়ে আসলাম। আবার নাকি গিয়ে নিয়ে আসতে হবে। উনার আদেশ।


বিপাশাকে পরীক্ষার হলে দিয়ে এসে কেন্দ্রের বাইরে এসে ভাবছি এতো সময় কী করবো ? বাসায় যাবো নাকি বসেই থাকবো ! সিদ্ধান্ত নিলাম বসে বসে অপেক্ষা করবো। রাস্তার পাশে দোকানে বসে বসে চা খাচ্ছি আর ওকে নিয়ে ভাবছি। কখনাে চা খেতে খেতে গান শুনি।


এভাবে সময়টা পার করে দেই। আর ওর ও পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। সবাই যখন গেইট দিয়ে বেরুচ্ছে এই দেখে আমি গেইটের কাছে একটু এগিয়ে গেলাম। একটু এগোতেই দেখলাম ও গেইট দিয়ে বের হয়ে আসলো। কাছে আসতেই বললাম,


-- কেমন হলো আপনার পরীক্ষা ?


ও আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। অতঃপর বললো,


-- হঠাৎ এতো রেসপেক্ট আসলাে কীভাবে ?


-- জানি না । তবে এখন থেকে আপনি করে বলবো ।


-- ওহ্ ! ভালো ।


ওর কণ্ঠে হতাশার ছোঁয়া।


-- পরীক্ষা কেমন হলো আপনার ?


-- হয়েছে ভালোই।


-- হুম। ভালো হলেই ভালো।


-- কেন ? তুই দোয়া করিস নি ?


-- হুম করেছি তো। আপনার জন্যে দোয়া করবো নাতো কার জন্যে করবো।


-- বাহ্ ভালো। তাহলে ভালো রেজাল্ট হবেই।


-- হতেই হবে । বউটা কার দেখতে হবে না।


-- কীরে ? কিছু বললি ?


-- না কিছু বলি নি।


-- তাহলে মনে মনে কী বলছিলি ?


-- না কিছু না।


-- মিথ্যে বলছিস কিন্তু ?


-- অনেক্ষণ তো হাঁটলাম। চলুন রিক্সায় উঠি।


এতোক্ষণ হেঁটে হেঁটে কথা বলছিলাম


-- না। বাকি পথ হেঁটেই যাবো। পরীক্ষাটা ভীষন ভালো হয়েছে।


-- আমি আর হাঁটতে পারবো না।


-- আমি মেয়ে হয়ে হাঁটতে বলছি আর তুই বলছিস হাঁটতে পারবি না !


-- না। আর হবে না আমার দ্বারা।


-- আচ্ছা রিক্সাতে উঠি চল ?


-- হুম।


একটা রিক্সা ডেকে উঠে পড়লাম। বসে আছি হঠাৎ উনি বলতে শুরু করলেন,


-- তুই আজকে এতোটা সময় এখানে বসে থেকেছিস ?


-- না। আমি তো বাসা থেকে এসেই তোমাকে নিতে আসলাম।


-- মিথ্যে বললি কেন ?


-- কী মিথ্যা বললাম ?


-- তুই জানিস আমার হলরুমটা দো-তলায়। আর দো-তলা থেকে রাস্তার সবকিছু স্পস্ট দেখা যায়।


-- হুম।


আর কিছু বললাম না।


-- ওখান থেকে স্পস্ট দেখা যায় তুই যেখানে বসেছিলি। আর এতোটা সময় বসে না থেকে বাসায় যেতে পারতি।


আমি শুধু মাথা নাড়লাম, ধরা পড়া অপরাধীর মতো। মাথা নিচু করে বসে আছি।


-- দুপুরে কিছু খেয়েছিস ? (বিপাশা আপি)


-- উহু না।


-- তো এখানে বসে না থেকে বাসা থেকে খেয়ে আসতি পারতি না ?


আমি আবারো মাথা নাড়লাম। হয়তো সম্ভব ছিলো। কিন্তু আমি যাই নি। নিজের প্রিয় মানুষটাকে ওখানে রেখে কী করে যাই। তাই আর কিছু না বলে চুপ করে অন্যদিকে তাঁকিয়ে আছি।


বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে পিসি নিয়ে বসলাম। কিছু ড্রয়িং করতে হবে অটোক্যাড-এ এবং ম্যাক্স-এ।


প্রতিদিন-ই বিপাশাকে আপু কে নিয়ে যেতাম আর নিয়ে আসতাম। দিনে দিনে আপুর প্রতি অনেকটা উইক হয়ে পড়ি। বাসায় যখন এসাথে টিভি দেখি বা কোনো কাজ করি তাহলে আমি তাঁকিয়ে থাকি অপলকে। আর উনি দেখলেই চোখ ফিঁরিয়ে নেই। তার জন্যে অবশ্য বকা ও খেয়েছি অনেক। আপুর সাথে অনেক ইজি হয়ে যাওয়ার পরে কেমন জানি লাগতো নিজেকে। ফাজলামোটা কমে গিয়েছে একেবারেই। একদিন আপুর সাথে রিক্সায় করে বাসায় ফিরছিলাম। আচ্ছা অপু তোকে একটা বলি,


আমি খানিকটা অবাক হলাম। আপু তো কখনো অনুমতি চায় না। তাহলে কী বলতে চায় ? অনেক ভাবার পরে বললাম,


-- হুম বলো। এতে অনুমতি চাইছো কেন ?


-- তুই আর আমাকে আপনি করে বলবি না। তুমি করে বলবি ?


-- কেন ?


-- তুমি বলতে বলেছি তুমি করেই বলবি। ব্যাস।


কথাটা রেগে বললো। তারপরে অন্যদিকে তাঁকিয়ে বললো,


-- আপনি ডাকলে কেমন জানি বয়স্ক লাগে নিজেকে। তাই আর আপনি বলবি না ঠিক আছে ?


-- হুম


এই বলে মাথাটা নাড়লাম কেবলি। আপু আবার জোড়ে বললো,


-- মুখে বলতে পারিস না। কী মাথা নাড়াচ্ছিস।


-- ঠিক আছে।


আস্তে করে বললাম। নিজেকে সুখী লাগছে। হয়তো আপু আমার ভালোবাসাটা ফিল করতে শুরু করেছে। হয়তো আমায় নিয়ে চিন্তা করে।


বাসায় এসে নিজের খুশিটাকে ছড়িয়ে দিতে একটা ছোট্ট পার্টির আয়োজন করলাম। কিন্তু আব্বু-আম্মু পার্টির কারণ জিজ্ঞাসা করলো কিন্তু বললাম না। বিপাশা আপু নিজেও কারণ জিজ্ঞাসা করলো, বলিনি। কারণটা এসে নিজেই কারণ জানতে চাইলে কী করবাে ? তারপরও আস্তে আস্তে করে বললাম, "তুমি ?"


-- আমি পার্টির কারণ !


-- হুম।


আমি মাথা নাড়লাম আবার। এবার আপু বললো,


-- শুধু মাথা না নেড়ে খুলে বল তো, তোর পার্টির কারণ আমি কেন ?


-- জানি না। তবে এটাই জানি তোমার জন্যে আয়োজন করেছিলাম।


-- হুহ। ভালো তো।


এই বলে চলে গেলাে তার রুমে। আমিও আর এ নিয়ে মাথা ঘামালাম না।


আস্তে আস্তে পরীক্ষা শেষ হয়ে এলো আর মাত্র ২ টা পরীক্ষা বাকি। আমাকে যে করেই হোক প্রপোজ করতে হবে। আমার বন্ধুদের কাছে থেকে সমাধান চাইলাম, কীভাবে প্রপোজ করা যায়। কিন্তু তাদের একটা যুক্তিও আপুর সামনে দাঁড় করাতে পারলাম না। তাই নিজের মনকে নিজের প্রবোধ দিলাম, নিজের মতো করে প্রপোজ করবো । বাকি দুইটা পরীক্ষাতে নিয়ে যাওয়া-আসার সময় একটুও কথা বলি নি। শুধু ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো কীভাবে প্রপোজ করবো।


সন্ধ্যায় বাসায় এসে দেখি আপু সবকিছু গুছাচ্ছে। কালকে সকালে চলে যাবে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে কালকে সকালেই প্রপোজ করবো।


সকালবেলা খুব ভোরে উঠলাম। এমন ভোরে আর কখনো উঠেছি বলে মনে হয় না। নিজেকে দ্রুত ফ্রেশ করে বারান্দায় আসতেই দেখি আপু খালি পায়ে বাগানে হাঁটছে। আর শিশির ভেঁজা ফুলগুলো হাত দিয়ে ছুয়ে দিচ্ছে। হয়তো ভেঁজা ঘাসটাও নিজেকে সুখী মনে করছে। আপু আলতো পায়ে ভেঁজা ঘাসে হাঁঠতে লাগলো। আমি ও খালি পায়ে বাগানে নেমে গেলাম। নিঃশ্বব্দে আপুর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটা ছোট্ট কাঁশি দিলাম। কাঁশির শব্দে আপু উল্টো ঘুরে থাকালো। ঘুরে অবাক হয়ে আমার দিকে তাঁকিয়ে রইলো। এতোটা অবাক করা চোখ কখনো দেখি নি। পরে আমার দিকে চোখ নাচিয়ে বলতে লাগলো,


-- ভূল কিছু দেখছি নাতো আমি ! আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না !


-- কেন হচ্ছে না !


-- তুই তো এতো ভোরে কখনো উঠিস না। তাই ?


-- আজকে না হয় উঠলাম।


-- তা এতো ভোরে উঠার কারণটা কী জানতে পারি জনাবের ?


-- না বিশেষ কোনো কারণ নেই। তবে ..


-- তবে কী ?


-- না কিছু না।


ভয়ে বললাম না। প্রপোজ করবো ভাবছি কিন্তু আমার হাত কাঁপছে । ভেতরে কেউ হাঁতুড়ি পিটাচ্ছে মনে হচ্ছে। এরই মধ্যে আপু বললাে,


-- চল্ হাঁটি।


-- হুম।


-- আমি তো চলে যাবো আর একটু পরে।


-- ওহ্হ্ !


-- তোকে অনেক ধন্যবাদ। আমাকে প্রতিদিন নিয়ে যাওয়া-আসা করার জন্যে।


-- ধন্যবাদ দিতে না। নিজের মানুষটার জন্যে এগুলো হয়তো কিছুই না।


-- নিজের মানুষ !


-- একটু ওয়েট।


এই বলে পকেট থেকে পায়েল টা বের করলাম। তারপরে সাদামাটা ভাবেই প্রপোজ করলাম। ও বললাে পায়েলটা আমার হাতে দে। আমি না বললাম, যে আমি পায়ে পরিয়ে দিবো। ও আবার ধমক দিয়ে বলায় হাতে দিয়ে দিলাম ভয়ে। হাতে দিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম। দাঁড়াতেই ঠাস্ স্ স্ করে একটা আওয়াজ হলো। আমাকে চড় মারলো খুব জোরে। এতো ভাবলাম না। প্রিয় মানুষটাই তো মেরেছে । কিন্তু তারপরে ও যা বললো আমি শোনার পরে আর ঠিক থাকতে পারলাম না। ও নাকি আমাকে ভালোই বাসে না। ওভাবে আমায় নিয়ে চিন্তাই করে না। আর ও ভালোবাসে অন্য কাউকে।


তারপরও আমি বললাম,


-- তুমি ভালো না বাসলেও আমি আজীবন বাসবো।


-- দেখ অপু পাগলামী করার একটা বয়স আছে। তোর এই বয়সটা পাগলামীর না। আর তোর-আমার সম্পর্ক সমাজ ভালো চোখে দেখে না।


-- তুমি যদি চাও সমাজ থেকে দূরে থাকবো। যেখানে সমাজটা হবে আমাদের দু'জনকে নিয়ে।


-- শুধু সমাজ কেন ? আমিও তাের ভালোবাসা মানি না।


-- কেন ?


-- বললাম না। আমাকে কেন-এর উত্তর জানতে চাইবি না। তোকে আমার অসহ্য লাগে। আর...


-- আর কী ?


-- আর তুই কখনে আমার সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করবি না।


এই বলে ও চলে গেলো। আমিও রুমে এসে অনেক্ষণ কাঁদলাম। সারাদিন রুমে মধ্যে বসে থাকলাম। বিকালে বের হয়ে শুনি বিপাশা চলে গেছে। কথাটা শুনে বুকের মধ্যে হালকা চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হলো। হয়তো এই সংকেতটাই ভালোবাসার।


এরপর থেকে আমার সবকিছু চেঞ্জ হতে লাগলো। ঠিক মতো খাই না। ঘুমাই না, গোসলও করি না অনেক দিন ধরে। বাসায় এসে ফ্রেন্ডসরা জোর করে ধরে নিয়ে যায় বাইরে।


এদিকে আমার অবস্থা দেখে আব্বু-আম্মুও বিপাশার আব্বু-আম্মুর সাথে কথা বলেন। প্রপোজের পর থেকে নাম ধরে ডাকি। ওর আব্বু-আম্মু অনেক বোঝানোর পরেও বিপাশা রাজি হয় নি। অনেক বুঝিয়েছে সবাই। ও নাকি পড়াশোনা শেষ করে ঐসব নিয়ে ভাববে।


এরমধ্যে একদিন খবর পেলাম ও এক্সিডেন্ট করেছে। শীঘ্রই আমি হাসপাতালে গেলাম। গিয়ে দেখি ও একটা বেডে শুয়ে আছে। বাম হাত আর ডান পায়ে ব্যান্ডেজ করা । দেখেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।


এগিয়ে গেলাম ও বেডের পাশে। ও ঘুমিয়ে আছে। পাশে আন্টি আর আঙ্কেল বসে কাঁদছে। কাঁদবেই না বা কেন ? একটা মাত্র মেয়ে। আমি আঙ্কেলকে সান্তনা দিচ্ছিলাম। আঙ্কেল আমাকে ধরে আরো জোরে কাঁদতে লাগলেন। উনার কান্না দেখে আমার ও কান্না আসছে। আন্টিকেও সান্তনা দিলাম। অনেক বুঝিয়ে তাদের বাসায় পাঠালাম। আম্মু আমার সাথে এসেছিলেন উনি নিয়ে গেছেন উনাদের। আমি পাশে বসে আছি একটা টুলে আর একজন নার্স ওকে দেখছে।


কিছুক্ষণ পর দেখি বিপাশা চোখ খুলে তাকাচ্ছে পিটিপিট করে । এখন সবার সামনেও নাম ধরে ডাকি। বিয়ে করতে হলে ওকেই করবো। আর নাম ধরেই তো ডাকে নিজের....


কিছুক্ষণ পরে নার্স এসে লাঞ্চ দিয়ে গেলো। আমি ওকে খাইয়ে দিতে লাগলাম। কিন্তু আমার হাতে খাবে না। তারপরে ধমক দিলাম একটা,


-- খাও বলছি ?


এবার ছোট্ট করে হাঁ করলো। আমার দিকে তাঁকিয়ে খেতে লাগলো । খাওয়া শেষে পানি খাইয়ে দিলাম। এভাবে যদি আজীবন খাওয়ানোর সুযোগ টা পেতাম। জানি না পাবো কী না।


-- নাও এবার একটু ঘুমোও ? (আমি)


এই বলে আমি বেডে শুইয়ে দিলাম।


-- চোখ বন্ধ করো। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।


ও কেমন করে জানি আমার দিকে তাকালো। তারপরে চোখ বন্ধ করলো । আমি সাদা কাঁথাটা ওর গায়ে টেনে দিলাম।


কয়েকদিনের মধ্যে হাঁসপাতাল থেকে ওকে রিলিজ করে দিলো। বাসায় নিয়ে এসেছি। আমাদের বাসায় নিয়ে আসলাম। স্ট্রেচার-এ ভর করে হাঁটতে হয়। আমি হাঁটতে দেই না। আমি ধরে ধরে হাঁটি। ওর মাথার পাশে বসে ওকে গল্প শোনাই। আর ও মনোযোগ দিয়ে শুনে কােনো রেসপন্স করেও না।


ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কীভাবে এক্সিডেন্ট করছিলো। ও বললো একসময় বলবে। আমি আর ওকে কিছু বললাম না। হয়তো আমার প্রতি তার ধারণা পাল্টেছে। কিন্তু তা হয় নি।


আস্তে আস্তে ও সুস্থ হয়। আর আমিও খুব করে ওর প্রতি উইক হয়ে যাই। ওকে আবার প্রপোজ করি। কিন্তু ও বললাে যে ১৪ ই ফ্রেবুয়ারী উওর দিবে। আমিতো অনেক খুশী। হয়তো উওর পাবো।


১৪ তারিখে গেলাম নির্দিষ্ট স্থানে। আমি বসে কিছুক্ষণ ওয়েট করলাম। দেখি বিপাশা একটা ছেলের সাথে আসছে। দেখেই আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলাে। বিপাশা এসে আমার পাশে বসলো, ছেলেটা তার পাশে বসলো তার হাত ধরে । এইটা দেখে নিজেকে আর নিজের মধ্যে রাখতে পারলাম না। ছেলেটাকে মারতে শুরু করি। শেষে বিপাশা আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে জোরে দুইটা চড় দিলো।


-- তুই ওকে মারছিস কেন ?


-- ও তোমার হাত ধরলো কেন ?


মাথা নিচু করে বললাম।


-- শোন তুই উওর জানতে চেয়েছিলি না তোর। এই দেখ ও হলো আসিফ । আমি ওকে ভালোবাসি আর ও আমাকে । আমরা দু'জনেই বাইরে যাচ্ছি পড়তে। এসে বিয়ে করবো।


কথাটা শোনার পরে আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। কার জন্যে আমি এতো কিছু করেছি। সেই সবের কী একটুও দাম নেই।


-- আর শোন।


আমি মাথা তোলে তাকালাম।


-- ধন্যবাদ দিলে কম হবে। তারপরও ধন্যবাদ।


আমি উচ্চস্বরে হেঁসে উঠলাম। ধন্যবাদ দিয়ে সবকিছুর প্রতিদান হয়? কী জানি হয়তো ওদের কাছে হয়ই।


-- আর তুই বলেছিলি না কীভাবে এক্সিডেন্ট করেছি। আমি ওর সাথে বাইকে ঘুরতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করেছিলাম।


আমি মাটির দিকে তাঁকিয়ে আছি। কষ্টে বুক ফেঁটে কান্না আসছে। মানুষগুলো এমন হতে পারে।


-- বাই। ভালো থাকিস। আর আমাকে ভূলে যাস।


ও চলে যেতে লাগলো ছেলেটার হাত ধরে। চাইলেও কী ভূলা যায়। হয়তো না।


এপরের সপ্তাহে শুনলাম ও পড়াশোনার জন্যে বাইরে চলে গেছে। নিজেকে শান্তনা দিয়ে রাখতে পারছি না।


আম্মু-আব্বু ও আমার কান্না দেখে কাঁদে। বিপাশার আব্বু-আম্মু এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইলো। ওদের কী অপরাধ আর বিপাশার-ই কী দোষ। সবাই যে সবাইকে পাবে এমন তো কথা নেই।


কিছু দিনের মধ্যে আব্বু আম্মু আমাকে নিয়ে চির দিনের জন্যে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে আসলো। কিন্তু আমার মনটা ঠিক-ই ওর কাছেই পরে আছে।


অস্ট্রেলিয়ায় এসে এই যান্ত্রিক পরিবেশ ভালো লাগে না। চেয়েছিলাম অনেকবার দেশে যেতে কিন্তু আব্বু-আম্মু যেতে দিতো না।


সবকিছুই ঠিক-টাক চলতো কিন্তু রাত্র হলেই কষ্টটা বেড়ে যেতো।


এভাবেই দিন কাটতে লাগলো....


এভাবে একদিন বসে আছি নিজ রুমে কেইন নামের একটা ফ্রেন্ড এসেছে। ওর সাথে নর্থ ওয়েলস-যাবো। হঠাৎ বাংলাদেশ থেকে ফোন আসলো। ধরেই সালাম দিলাম। আমাকে বললেন আমি অপু কিনা ? বোঝলাম আঙ্কেল (বিপাশার বাবা)


আমি হ্যাঁ বলতেই বললেন, "বাবা বিপাশা খুব অসুস্থ বাংলাদেশে আসছে তোমায় দেখতে চায়। তুমি যদি একটু আসতে ? "


-- আমি ? আমি কেন আসবো ?


-- আমি তোমার বাবার মতো। আমার অনুরোধ রইলো তোমার প্রতি।


-- ছি ছি এসব কী বলছেন আঙ্কেল ? আমি আসছি।


-- ওকে বাবা। তোমার আব্বু-আম্মুকে বলো।


আঙ্কেল কাঁদতে কাঁদতে ফোন রেখে দিলেন। বিপাশার কথা শুনে আমার মনটা কেঁদে উঠলো। কেইনকে বললাম, "দোস্ত আমার জন্যে একটা টিকিট কর সিডনি-বাংলাদেশ।"


-- Okkee dear. Don't worry. I solve it few moment.


-- Thank you Dear.


কিছুক্ষণ পরে ও টিকিট কেটে আমাকে ফোন দিলো, সবকিছু ওকে। আমি রেডি হয়ে আম্মু-আব্বুর উদ্দেশ্যে একটা চিরকুট লিখে বেরিয়ে পরলাম বাংলাদেশ যাওয়ার জন্যে। মন চায় উড়ে চলে যাই। কিন্তু চাইলেও সম্ভব না। ফ্রেন্ডের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে পা বাড়ালাম সামনের দিকে ।


চোখের সামনে বিপাশার মুখটা শুধু ভাসছে । অনেক দিন পরে দেখা হবে। কেমন আছে এখন। দেখতে কেমন হয়েছে। এসব ভাবছিলাম বিমানের ভেতরে বসে।


দীর্ঘক্ষণ পরে এসে দেশের মাটিতে পা দিলাম। মনে একধরণের সুখের টান অনুভব করছি। বিমানবন্দর থেকে সোজা চলে এলাম হাঁসপাতালে। আসার আগে আঙ্কেলের সাথে যোগাযোগ করে হাঁসপাতালের নাম, অবস্থান জেনে নিয়েছিলাম। তাছাড়া আমার ফ্রেন্ড রিয়াদ ও আমায় সাহায্য করছে ।


হাঁসপাতালে ঢোকে ওদের কেবিন টা খুঁজে বের করতে খানিকটা বেগ পেতে হলো। কেবিন খুঁজে বের করে তাড়াহুড়ো করে রুমে ঢোকলাম। রুমে ঢোকতেই একটা ঠান্ডা স্রোত শরীরের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেলো। আন্টিও পাশে বসে ছিলো । আন্টির চোখগুলো লাল আর অনেক ফোলা হয়তো ঘুমায় নি, শুধু কান্না করেছে। আর ঘুমাবেই বা কী করে। একমাত্র মেয়ে অসুস্থ। নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে মেয়ের পাশে বসে আছে। আমি গিয়ে আস্তে করে আন্টির কাঁধে হাত দিলাম। আন্টি নিজেকে খানিকটা হেঁলিয়ে দিলেন আমার উপর। হয়তো কিছু একটা ভারসাম্য খুঁজে চলছেন আন্টি । জানি না পাবেন কী না।


বিপাশার দিকে খেলায় করলাম, একটা সাদা চাদরে গলা পর্যন্ত ঢেকে আছে। শুকিয়ে একেবারে কঙ্কালসার। আমার চোখে পানি চলে আসছে ওর এই অবস্থা দেখে। মনটা কিছুতেই প্রবোধ মানছে না। কীভাবে এসব হলো কিছুই বোঝতে পারছি না। আমি ওর পায়ের কাছে ওর বেডে বসলাম। বসে ওর দিকে তাঁকিয়ে আছি। আন্টিকে জিজ্ঞাসা করলাম, "কিছু খেয়েছেন কিনা ?" মাথা নাড়লেন কেবল।


আমি আন্টিকে রেখে বাইরে থেকে খাবার কিনে নিয়ে গেলাম। তারপর আমি নিজ হাতে আন্টিকে খাইয়ে দিলাম। আন্টি এখন খুব কাঁদছেন। আমি সান্তনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। তাছাড়া আমি নিজেই কাঁদছি। তারপরেও মিছে সান্তনা দিলাম। কিছুক্ষণ পরে আঙ্কেল এসে রুমে প্রবেশ করলেন। হাতে অনেকগুলো ফাইল। হয়তো রিপোর্ট নিয়ে এসেছেন। আঙ্কেল এসে আন্টির পাশে আরেকটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন। দেখে একেবারেই নির্জীব লাগছে। যেন প্রাণ হাঁরিয়ে ফেলেছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম,


-- কী হয়েছে আঙ্কেল ? ডাক্তার কী বললো ?


-- কিছু না বাবা।


অনেক কষ্টে কথাগুলো বললেন। হয়তো মুখ দিয়ে কোনো বের হতে চাইছে না। চুল গুলো উসখুস করা। চেহারাটা রুক্ষ। আমি আবার উনার দিকে তাঁকিয়ে বললাম,


-- আঙ্কেল আমি আপনার ছেলের মতো আপনি আগেই বলেছেন। তাই ছেলে হিসেবে বলেন ।


-- আমার সাথে আসো।


আঙ্কেল আমাকে ডেকে বাইরে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার যা বলেছে হয়তো তা আন্টিকে শুনাতে রাজি নন। এমনিতেই অনেক কষ্ট পাচ্ছেন আন্টি। তাই না শুনানোই বেটার।


-- আঙ্কেল বলুন এবার ওর কী হয়েছে ?


আঙ্কেল কিছুক্ষণ আমার দিকে নিষ্পলক তাকালেন। তারপরে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। আর কান্না ভেঁজা কণ্ঠে বললেন,


-- অপু বাবা ওর কিডনী দু'টোই ড্যামেজ হয়ে গেছে।


-- কী বলছেন আঙ্কেল এসব ? রিপোর্ট ভূল আসছে মনে হয় !


-- আমি অনেকবার টেষ্ট করিয়েছি। ডাক্তার বললো আগামী ৭২ ঘন্টার মধ্যে কিডনী না পেলে তাকে আর বাঁচানো সম্ভব না।


-- আমি সব দেখছি আঙ্কেল। আমি ভেঙ্গে পড়বেন না।


-- আমার মেয়ে বাঁচবে তো !


এই বলে আঙ্কেল আমাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে ঢুঁকরে ঢুঁকরে কাঁদতে লাগলেন। একথা শোনার পরে আমারও মন মানছে না। যে করেই হোক ওকে বাঁচাবো আমি। আমার ভালোবাসা এতো সহজে হাঁরতে দিবো না।


হঠাৎ সামনে চোখ পড়তেই দেখি আন্টি দাঁড়িয়ে আছেন। তারমানে উনি সব শুনলেন। আমি আঙ্কেল কে ছেড়ে দিলাম। আন্টি ধীর পায়ে এগিয়ে আসলেন। মুখে আচঁল দিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছেন। কাছে এসেই বললেন,


-- আমার মেয়ে কী বাঁচবে না আর ?


-- জ্বী আন্টি বাঁচবে। আমি বাঁচাবো তাকে। আপনি আর কাঁদবেন না।


সেই সময় থেকে আমি আর রিয়াদ মিলে একদিনে সারা শহর খোঁজলাম। আমি সন্ধ্যায় এসে ওর কেবিনে আবার ঢোকলাম। দেখি আম্মু-আব্বু চলে এসেছেন। আঙ্কেল দৌড়ে এসে আমায় বললেন, "বাবা পেয়েছো ?" আমি শুধু বললাম, "চিন্তা করবেন না আঙ্কেল। আমি পাবোই।" আঙ্কেল কিছুটা নিরাশ হয়ে গিয়ে চেয়ারটায় বসে পড়লেন। আমি আব্বু-আম্মুকে বললাম, "উনাদের কিছু খাইয়ে নিয়ে আসতে।" আমি পাশে আছি ওর।


সবাই যাওয়ার পরে আমি চেয়ারটা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বিপাশার একদম কাছে বসেছি। ওর শ্বাস-প্রশ্বাস শুনতে পাচ্ছি। ঘুমিয়ে আছে। কতোটা নিষ্পাপ লাগছে ওকে। মনে হচ্ছে ছোট্ট কোন বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে। এতো পবিত্র লাগছে তাকে। আমি আলতো করে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম। হঠাৎ ও চোখ খুলে পিট পিট করে তাঁকালো। চোখ খুলে আমার দিকে চেয়ে আছে। কতোটা কোমল আর কতোটা গভীর সে চাহনী। অনেক্ষণ তাঁকিয়ে রইলো। আমিও তাঁকিয়ে রইলাম ও চোখের দিকে। গভীরতা খোঁজতে ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। কিন্তু জানি কখনোই পাবো না। হঠাৎ ও চোখটা সরিয়ে নিয়ে বলে উঠলো,


-- কেমন আছিস তুই ?


-- হুম। তোমায় ছাড়া যেমনটা থাকা যায়।


-- হুম। আমিতো পচাঁ। আমাকে ক্ষমা করে দিস ?


-- এসব কী বলছো ? ক্ষমা চাইছো কেন ?


-- আমি তোর সাথে প্রতারণা করেছি। তাই আল্লাহ্ আমায় এই শাস্তি দিলেন।


-- কী বাজে বকছো ? আমি ওসব ভূলে গিয়েছি।


-- না তা হয় না। ক্ষমা না করলে আমি মরেও শান্তি পাবো না।


-- চুপ ওসব কথা একদম বলবে না। আমি থাকতে কিছুই হতে দিব না।


-- পারবি নারে। আমি আর খুব বেশী দিন বাঁচবো না। আর আমার কিডনী ও জোগাড় হয় নি।


-- কে বলেছে ? কালকে রাত্রেই তোমার অপারেশন হবে। তুমি আগের মতো সুস্থ হয়ে যাবে।


-- হবে নারে।


-- আচ্ছা পরে দেখা যাবে । এবার চুপটি করি ঘুমাও।


-- এখন আর ঘুমিয়ে লাভ কী ? কয়েকদিন পরে একেবারে ঘুমাবো।


-- বলছি না ঘুমাও। চোখ বন্ধ করো। আমি চুলে বিলি কেটে দিচ্ছি।


ও চুপটি করে চোখ বন্ধ করলাে। আমি ওর পাশে বসে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম। হয়তো কেউ জানবে শুধু রিয়াদ ছাড়া।


আন্টি-আঙ্কেল আসতেই আমি বাইরে গেলাম রিয়াদের কাছে। আগামীকাল সকাল থেকেই খোঁজতে হবে। যদি না পাই তো আর কিছুই করার নেই। নিজের কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতেই হবে।


এরপরের দিন রিয়াদ আর আমি সারাদিন ধরে খোঁজলাম। পেলাম না। একটাও না। অধিক টাকার লােভেও কেউ দিবে না।


সন্ধ্যায় ফিরে আসলাম। আমি কেবিনে ঢুকতেই সবাই এগিয়ে আসলাে। পরে যে খবর শুনলো সবাই নির্বাক। অপারেশনের আর ৪ ঘন্টা আছে। অথচ কোনো কিডনী পায় নি। তারপরে কী বলে আবার বেরিয়ে গেলাম আমি।


এর কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার এসে জানালো যে দু'টো কিডনীই পাওয়া গেছে। কিন্তু অপু কই ? অপুকে তো দেখছি না,আম্মু বললেন।


আন্টি বললেন হয়তো নিচে গেছে। আসতে একটু দেরী করছে।


অপারেশনের জন্যে রোগীকে প্রস্তুত করেন। ঠিক সময়েই অপারেশন শুরু হবে। এই বলে ডাক্তার চলে গেলাে।


সবাই বিপাশাকে নিয়ে যাচ্ছে অপারেশন থিয়েটারে। কিন্তু ও জিদ ধরে আছে। আমি অপুর সাথে কথা বলে যাবো। নাহলে যাবো না। আঙ্কেল বললেন, মারে এটা পাগলামী নয়। তোর অপারেশন সাক্সেসফুল হওয়ার পরেও তুই দেখতে পাবি।


না যাবো না। সবাই ওকে জোর করে পাঠালো। ও বলে গেলো, অপু আসুক ওকে মজা দেখাবো। আমাকে রেখে কই গেছে। আমাকে সুস্থ হতে দাও তারপরে দেখাবো ওকে মজা। আমাকে রেখে কই যায় ?


ও চলে গেলো অপারেশন থিয়েটারে। সবাই বাইরে বসে আল্লাহ্-এর না ঝপ করছে। কিন্তু অপুকে কেউ দেখছে না এরপরে আর আসে ও নি। ফোনটাও বন্ধ করে আছে।


দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা পরে ওকে কেবিনে নিয়ে আসা হলো। ওকে ঘুম পাঁড়িয়ে রাখা হয়েছে।


এরপরের দিন সবাই ওকে দেখতে কেবিনে ঢোকলো। কিন্তু অপু আসে নি। বিপাশা ওর বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো,


-- বাবা অপু কই ?


-- জানি নারে মা। হয়তো আছে কােথাও আশে-পাশে।


-- আমাকে দেখতেও আসলো না। বোঝাবে মজা আসলেও।


-- ঠিক আছে মা। তাই করিস।


সবাই বের হয়ে গেলো কেবিন থেকে। নার্স এসে ওকে চেক-আপ করে গেলো।


আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠছে। একদিন হাঁসপাতালে সবাই বসে আছে ওর কেবিনে আর ও বারান্দায় দাঁড়িয়ে আঁকাশ দেখছিলো। অপুর কথা ভাবছিলো। হঠাৎ একটা ছেলে চিঠি দিয়ে গেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়েই চিঠির ভাঁজ খুলে পড়তে শুরু করলো,


প্রিয় বিপাশা আপু,


চিঠিটা যখন তোমার কাছে পৌঁছাবে, তখন আমি তোমার থেকে অনেক দূরে। কোনোদিন হয়তো আপু বলে ডাকতে চাই নি। কিন্তু শেষ সময়ে ডাকলাম। অনেক ফাজলামো করতাম তোমার সাথে। ক্ষমা করে দিয়ো ভূল মনে করে। তোমাকে অনেক ভালোবাসতাম। আজও বাসি । কিন্ত আঙ্কেলের মুখে তোমার অসুস্থতার খবর শুনে ছুটে আসি। আমার ভালোবাসার মানুষটা অসু্স্থ। কিন্তু তুমি কী আমায় আদৌও ভালোবাসতে। হয়তো না। তোমার ভালোবাসা পাবার যোগ্য আমি হয়তো ছিলাম না। আন্টির মুখে তোমার স্বপ্নের কথা শুনেছি। আন্টির কান্না দেখেছি তার সাথে আমিও কেঁদেছি। তোমাকে হাঁরালে তারা কী নিয়ে বাঁচবে। আর আঙ্কেল-এর কান্না গুলো দেখে আমিও কেঁদেছি। একটা মেয়ের জন্যে তার বাবার এতোটা ভালোবাসা আমি হয়তো আঙ্কেলকে না দেখলে বোঝতাম না। আমি তাদের কান্না সহ্য করতে পারি নি।


আমার ভালোবাসা এতো ঠুনকো ছিলো। তাই মৃত্যুর কাছে আমার ভালোবাসাকে এতো সহজে হেঁরে যেতে দিই কী করে ? তাই তোমাকে ভালোবেসে তোমাকে বাঁচিয়ে রেখে গেলাম। পূরণ করো আন্টি আঙ্কেলের স্বপ্ন যা তারা তোমায় নিয়ে দেখে।


আর আমি...


আমি নাহয় তোমার মধ্যেই বেঁচে থাকবো। যতোদিন তোমার নিঃশ্বাস পড়বে ততোদিন আমিও বেঁচে থাকবো। আমি তোমার যোগ্যই ছিলাম না। কী করে তোমার ভালোবাসা পাবো বলো।


অনেক ভালোবাসি তোমায়। হয়তো পরকালেও বাসবো। তোমায় পাবো না তো কী হয়েছে ? তোমাকে তো দূর আঁকাশ থেকেও ভালোবাসবো। প্রিয় মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকবো। আমি কতোটা ভাগ্যবান তাই না ? আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো তোমার অপারেশনের সময় ছিলাম না। হাজার হোক প্রিয় মানুষটাকে কস্ট পেতে দেখি কী করে বলো। তাই না বলে না জানিয়েই চলে গেলাম। আমার আম্মু-আব্বু একটু বুঝিয়ে বলো। তোমার কথায় তারা বোঝবে। কিন্তু তাদের কখনো আমার অভাবটা বোঝতে দিয়ো না। তারা সন্তান হাঁরাবার ব্যথা সহ্য করতে পারবে না।


আর কখনো বিরক্ত করতে আসবো না। কেউ আর নাম ধরেও ডাকবে না । তুমিও আর কাউকে বকতে পারবে না পাগল বলে । আর কখনোই আসবোনা। তোমার কাছে। খুব সুখী হও তুমি। নিজের মতো করে ভালো একজন মানুষ খুঁজে নিয়ো। আর এই পাগলটাকে ভূলে যেও। ওর দেয়া কষ্টগুলা ভূল মনে করে ভূলে যেও।


দূর আঁকাশ থেকেই নাহয় ভালোবাসবো। সেখানে থাকবেনা কোনো চাওয়ার ইচ্ছা। আর আসবো কখনো। আর কখনো পাগলামী ও করা হবে।


তোমার মধ্যেই বেঁচে থাকার আশ্রয় খুঁজে নিলাম


ভালো থেকো সবসময়। আর নিজের খেয়ালটুকু রেখো। আমিও ভালো থাকবো। তবে মাঝে মধ্যে আমার অতৃপ্ত আত্নাটা এসে তোমায় দেখে যাবে একনজর। তাড়িয়ে দিয়ো না....


. . ইতি


তোমার সেই পাগলটা


হতে চেয়েও পারি নি


পেছনে এসে বিপাশার আম্মু দাঁড়িয়ে বললেন, "কীরে মা কাঁদছিস কেনো ? আর চিঠিটা কে দিয়েছে ?


বিপাশা তার বাবা-মাকে জরিয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।


-- বাবা অপু আমায় কিডনী দিয়ে বাঁচিয়েছে।


-- কী বলছিসরে মা ?


চিঠিটা বিপাশা তার বাবার হাতে দিলো। সবাই মিলে পড়তে লাগলো। চোখ বেয়ে অবিরাম অশ্রু ঝরছে সবার।


কেউ হয়তো সন্তান হাঁরিয়ে কাঁদছে আর কেউ হয়তো কাঁদছে তার মেয়েটাকে বাঁচিয়ে দিয়ে ঐ ছেলেটা চলে যাওয়ার জন্য। কাঁদুক না তারা এমন করে কী কান্না করবে কখনো সবাই।


হয়তো /হয়তোবা না.....।।।

No comments

Powered by Blogger.