তোর_পিরীতে_পাগল_হইলাম_রে
পর্ব_১
নিষিদ্ধ পল্লীর এক আলোকসজ্জিত ঘরের বিছানায় অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটাচ্ছে দুজন মানব মানবী।যদিও সন্ধ্যের পরে এই জায়গাটার কোলাহল কিংবা ব্যস্ততা সব বেড়ে যায় তবে ফিরোজের এই জায়গাটায় আসার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই।যখন মন চায় তখনই আসে।
ফোনের শব্দে ফিরোজ বেশ বিরক্ত হলো নিজের কাজে বাধা সৃষ্টি হওয়ায়।ফিরোজ ফোনটা রিসিভ করতে চাইলো তবে টুম্পা ওকে ছাড়লো না।নিজের সাথে আরো ভালো করে জড়িয়ে নিল ফিরোজ কে,উঠতে দিল না।ফিরোজও খুব বেশি পাত্তা দিল না।তবে মুহূর্তের ব্যবধানে আবারও ফোনটা শব্দ করে চেঁচিয়ে উঠলো।এবারে ফিরোজ প্রচন্ড বিরক্ত হলো সেই সাথে টুম্পাও।টুম্পার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ফোনটা কানে ধরে অপর পাশে থাকা ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে অশ্রাব্য গালি দিয়ে বলল,
“বা/ন্দি/র বাচ্চা তোরে বইলা আসি নাই যে আমারে যেন এখন কেউ বিরক্ত না করে?”
ছেলেটা বোধহয় একটু থতমত খেল।তবে যেহেতু এখন কল করে ফেলেছে কেন কল করেছে সেই কারণটা না বলে তো ফোনটা রাখা যাবে না।তবে প্রথমে ক্ষমা চাইতে হবে নিজের অপরাধের জন্য।
“ক্ষমা করবেন ভাই।আসলে একখান খবর দেয়ার জন্যে আপনারে ফোন করছিলাম।”
“কি খবর?”
“ভাই বাজারে আরজু ভাবি আসছে।”
মুহূর্তের মাঝে ফিরোজের অভিব্যক্তি বদলালো।নিজের উন্মুক্ত বুকের উপরে মাথা রাখা টুম্পাকে সরিয়ে দিল।উঠে বসে তাড়াহুড়ো কণ্ঠ ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“দশ মিনিটে আসছি।”
ফিরোজ তাড়াহুড়ো করে ফোনটা রেখে গায়ে টি-শার্টটা জড়ালো।হঠাৎ করে ফিরোজের এত তাড়াহুড়ো টুম্পার মনে অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি করলো।এইতো একটু আগে এসে বলল আজ নাকি হাতে অনেক সময় নিয়ে এসেছে,যাওয়ার কোন তাড়াহুড়ো নেই তবে এখন এই তাড়া কিসের?প্রশ্নাত্মক গলায় জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় যাচ্ছ তুমি?আর কে কল করেছিল?”
ফিরোজ ব্যস্ত গলায় বলল,
“দলের একটা ছেলে কল করেছিল
আরজু এসেছে বাজারে।”
আরজু নামটা শুনতেই টুম্পার বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচর দিয়ে উঠলো। টুম্পা জানে ওর কষ্ট হওয়া উচিত না কিন্তু তারপরও কষ্ট হলো।
“আরজু এসেছে জন্য এভাবে আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছো?”
“এটাতো আজ নতুন না যে আরজুর জন্য তোমায় আমি ফেলে রেখে যাচ্ছি।পুরনো কথায় এত কষ্ট পাওয়ার কিছুই নেই।”
টুম্পা বিছানার এক কোণায় পড়ে থাকা শাড়িটা কোনরকমে গায়ে জড়ালো।বিছানা থেকে নেমে ফিরোজের মুখোমুখি দাঁড়ালো। ফিরোজ ততক্ষণে বেরিয়ে পড়ার জন্য একেবারে তৈরি।যাওয়ার জন্য পা বাড়লো তবে টুম্পা থামালো।ফিরোজ এতে বেশ বিরক্ত হলো।
“কি সমস্যা?আটকাচ্ছো কেন?”
টুম্পা হাতের আজলায় ফিরোজের মুখটা নিল।চোখে মুখে তার কত আকুতি ফিরোজ কে যেতে দেবে না জন্য,কত কষ্ট ফিরোজ ওকে ফেলে রেখে যাচ্ছে জন্য।দুচোখ ছল ছল করছে তবে সে সবকিছু ফিরোজের উপরে প্রভাব ফেলতে পারলো বলে মনে হয় না।বরং সে বিরক্তিকর গলায় বলল,
“দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার ছাড়ো।”
টুম্পা ক্রন্দনরত স্বরে বলল,
“তুমি না আমায় বলতে ফিরোজ যে তুমি আমায় ভালোবাসো।তুমি না বলতে যে আমার ছোঁয়া পেলে তোমার সব দুঃখ,কষ্ট,দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়।তুমি না আমায় বলতে আমায় কাছে পেলে তোমার পাগলামো বেড়ে যায়।তাহলে আজ কেন আমায় ফেলে চলে যাচ্ছো ওই মেয়েটার কাছে যে তোমাকে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবে না?”
“তোকে ভালোবাসি সেটা ঠিক আছে।কিন্তু তার মানে তো এটা না যে আর কাউকে ভালোবাসা যাবে না।”
ফিরোজের সম্বোধন তুমি থেকে তুই তে চলে এসেছে যা টুম্পা কে হাসালো।নিজের গুরুত্ব ঠিক কতটা কম সেটা টুম্পা আরো একবার বুঝলো।তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“একসাথে দুজনকে ভালোবাসা যায়?আমি তো কখনো আর কাউকে ভালোবাসতে পারলাম না।কত খদ্দের তো আসে,আমার রূপে তারা নিজেদের সব কিছু বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকে কই আমি তো কখনো তাদের কাউকে আপন করি না তুমি ছাড়া।”
কথাটা বলার সাথে সাথে ফিরোজ টুম্পার চোয়াল চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“খবরদার যদি আর কখনো তোর মুখে অন্য কাউকে ভালোবাসার কথা আমি শুনেছি তো।ভুলে গিয়েছিস অন্য কেউ তোর গায়ে হাত দিয়েছিল জন্য তোর আর তার কি অবস্থা করেছিলাম?কান খুলে একটা কথা শুনে রাখ,আজ যে ভুলটা করলি ছেড়ে দিলাম।এর পরে যেন আর কখনো এই ভুলটা না হয়।আমার জিনিসের ওপর যে নজর দেবে চোখ উপড়ে ফেলবো তার আমি।”
এই যে ফিরোজ এত শক্ত করে টুম্পার চোয়ালটা চেপে ধরেছে এতেও টুম্পার একটুও কষ্ট হলো না।বরং টুম্পার ভীষণ ভালো লাগলো।মনে হলো ফিরোজ ওর উপরে অধিকার দেখাচ্ছে।আর অধিকার তো সেখানেই দেখানো যায় যেখানে ভালোবাসা থাকে।তবে যদি টুম্পাকে ভালোবাসে ফিরোজ তবে আরজুর কাছে বারবার কেন ছুটে যায়?
টুম্পার গাল বেয়ে কয়েক ফোটো অশ্রু গড়িয়ে পরলো।টুম্পার কান্না দেখে ফিরোজ ওর চোয়ালটা ছেড়ে দিলো।টুম্পার যেন এটা আরো ভালো লাগলো।তবে টুম্পার চোখের জল ফিরোজ কে একটু হলেও দুর্বল করতে পারে।
ফিরোজের সারা মুখে অজস্র চুমু খেয়ে বলল,
“আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো।তবে আরজু কে ছেড়ে দাও না!বিয়ে করে নাও আমাকে।আমাকে এই অন্ধকার জীবন থেকে মুক্তি দাও।তুমি তো চাইলেই পারো বলো।আমরা দুজন সংসার করি চলো না।আমারও একটা সংসার হোক।এই অন্ধকার জগতের বাইরে আমারও একটা ঘর হোক।আমিও একটু ভালোবাসা পাই তোমার থেকে।”
ফিরোজ গম্ভীর গলায় বলল,
“ছাড় আমাকে।”
টুম্পা ছাড়লো না,আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।এবারে তার আকুতি বাড়লো,কান্নার বেগ বাড়লো।হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল,
“আমাকে ছেড়ে যেও না ফিরোজ।ওই মেয়ের কাছে তোমার বারবার ছুটে যাওয়া আমাকে খুব কষ্ট দেয়।আমার হৃদয়ে র/ক্তক্ষরণ হয়। মনে হয় কেউ বারবার ছু/রি দিয়ে সমানে আঘাত করে যাচ্ছে ওখানটায়।আমি তো তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।তোমার ভাগ আমি কাউকে দিতে পারবো না।তুমি আরজু কে ভুলে যাও,আমাকে বিয়ে করে নাও।আমরা দুজনে সংসার করবো।”
নিজের রাগ ফিরোজ এবারে আর কোন মতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না।টুম্পাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ছুঁড়ে মা/রল বিছানার উপরে।টুম্পা হুমড়ি খেয়ে বিছানার উপরে পড়ল।হাঁটুতে একটু ব্যথাও পেল।
পেছনে দাঁড়ানো ফিরোজ তাচ্ছিল্য ভরা কণ্ঠে বলল,
“তুই হলি বে/শ্যা।তোদেরকে শুধুমাত্র কয়েক মুহূর্তের আনন্দের জন্য বিছানাতেই মানায়, সংসারে না।তোরা হলি শুধুমাত্র মনোরঞ্জনের জন্য আর সংসার করার জন্য আরজুদের দরকার।ভুলেও আর কখনো আরজুর জায়গা নেওয়ার চেষ্টা করবি না।তোর জায়গা এখানে,কেবল আমার শরীরে তাও যতদিন আমি চাইবো।আর আরজুর জায়গা আমার মনে,আমার ঘরে,আমার পুরো জীবনে বুঝতে পেরেছিস?”
কথাগুলো বলে ফিরোজ চলে গেল।টুম্পা বিছানার ওপরে কান্নায় ভেঙে পড়লো।
অদ্ভুত জীবন টুম্পার।চার দেওয়ালের মাঝে বন্দী,এই অন্ধকার জগতের মাঝে বন্দি।যে পুরুষরা নিজেদের আনন্দের জন্য ওদের কাছে আসে সেই পুরুষরাই সম্মান দেয় না। নিজেদের প্রয়োজন শেষ হলে এভাবেই ঠিক ছুঁড়ে মা/রে,অমানুষের মতন আচরণ করে। অথচ ঠিক তেমনি একটা মানুষকে ভালোবেসে ফেলেছে টুম্পা।টুম্পা জানে ওই মানুষটাকে ভালোবাসা ওর অন্যায় হয়েছে কিন্তু কি করবে।না ভালোবেসে তো থাকতে পারেনি।মানুষটা নিজের ভালোবাসার সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছিল টুম্পাকে।টুম্পার গায়ে অন্য কারো ছোঁয়া লেগেছিল জন্য মানুষটা সহ্য করতে না পেরে কত ঝামেলাই না করলো।এত অবহেলা,অবজ্ঞার মাঝে যখন ওই মানুষটার থেকে এক টুকরো ভালোবাসা পেল,একটু যত্ন পেল তখন যে টুম্পা ওকে ভালোবাসতে বাধ্য হয়েছিল।তখন তো আর টুম্পা বোঝেনি সেই ভালোবাসাটুকু শুধুমাত্র এই ঘরের বিছানার মাঝে সীমাবদ্ধ।টুম্পার ভালোবাসা কখনো সংসারে পরিণত হতে পারবে না।
_______
“ফিরোজ পথ ছাড় আমার না হলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে বলছি।”
আরজুর কথার প্রেক্ষিতে ফিরোজের মাঝে বিশেষ কোনো হেলদোল দেখা গেল না।আর না সে নিজের জায়গা থেকে নড়লো।বেশ স্বাভাবিকভাবে বলল,
“শহরে গিয়ে কি নতুন কাউকে জুটিয়েছিস নাকি আরজু?আমার কথা বুঝি আজকাল মনে পড়ে না?”
আরজু কাট কাট গলায় বলল,
“তোর কথা আমার কোনদিনও মনে পড়তো না ফিরোজ।আর আমি কাউকে জুটিয়েছি নাকি না জুটিয়েছে সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার তোকে এর মাঝে নাক গলানোর অধিকার আমি দেইনি।পথ ছাড়।”
“আমার হবু বউ তুই।তোর সম্পর্কে জানার আর বলার অধিকার আছে আমার।”
আরজু ব্যাঙ্গাত্মক কন্ঠে বলল,
“কি বললি তুই?তোর বউ?হাসালি ফিরোজ। এর চাইতে ভালো আমি রাস্তার কোন কুকুরকে বিয়ে করে নেব তবুও তোকে বিয়ে করবো না।নিজের নামের সাথে তোর নামটা জড়ানোর আগে আমি গলায় দড়ি দিয়ে মর/বো তবুও তোর মতন দুশ্চরিত্রের বউ হবো না।”
আরজুর কথা শুনে ফিরোজ হো হো করে হেসে উঠলো।হয়ত কটাক্ষ করলো আরজু কে।কোনো মজবুত খুঁটি ছাড়া আরজুর কন্ঠের তেজটা যেন ফিরোজের কাছে খুবই হাস্যকর মনে হলো।
আরজুর কাছে ফিরোজের এই হাসিটা খুব নোংরা লাগলো।অবশ্যই এই ছেলের প্রতিটা বিষয়ই আরজুর নোংরা লাগে।
ফিরোজ নিজের হাসি থামিয়ে বলল,
“বউ তো তুই আমারই হবি ঠিক যেমন তোর বোন আমার ভাইয়ের বউ হচ্ছে।”
“আমাকে আপার মতন দুর্বল ভাবিস না ফিরোজ।তোর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যদি আমি নিজে মর/তে পারি তাহলে প্রয়োজনে তোকেও মা/রতে পারি।তোর ভাইকে বলে দিস যেন ওই বুড়ো আমার আপার সাথে ভালো ব্যবহার করে।না হলে ওর কপালে দুঃখ আছে।”
“আমাকে মা/রলে তোর কি মনে হয় তোর ভাই তোকে ছাড়বে?দু দুবার জেল থেকে ছাড়িয়ে এনেছি ওকে,ওর পিছনে এত টাকা ঢালছি কি এমনি এমনি নাকি।”
“আমি কি তোকে একবারও বলেছি যে ওকে মা/রতে পারবো না?ওকে যদি নিজের ভাই ভাবতাম তাহলে মা/রতে পারতাম না।কিন্তু আমি ওকে এই সমাজের কলঙ্ক মনে করি যাকে মা/রতে আমায় একটুও ভাবতে হবে না।”
“সবকিছু এত সহজ ভাবিস না।যতই হোক দিনশেষে আমার ক্ষমতা আর শক্তির কাছে তুই খুবই নগণ্য।তোকে আমার থেকে বাঁচানোর মতনও কেউ নেই।ওই দেখ দূরে তোর ভাই দাঁড়িয়ে আছে।তোর জন্য না, আমার জন্য।তুই ডাকলেও আসবে না।”
আরজু একবার ওদের থেকে একটু দূরে চায়ের দোকানে বসে কয়েকজন ছেলের সাথে আড্ডরত প্রিথুলের দিকে তাকালো।ভাইয়েরা নাকি বোনদের রক্ষাকবচ হয়?নিজের জীবন দিয়ে হলেও নাকি বোনের সম্মান রক্ষা করে?আর আরজুর ভাই নিজেই ওর বোনের সম্মান নষ্টের জন্য দায়ী।
প্রিথুলের দিকে দৃষ্টি রেখে আরজু শান্ত কণ্ঠে বলল,
“কে বলল ও আমার ভাই?ও শুধু আমার বাবা-মায়ের ছেলে,আমার ভাই না।ভাই হওয়ার যোগ্যতা ওর নেই।”
কথাটা বলে আরজু চলে যেতে নিলে পিছন থেকে ফিরোজ ওর হাত টেনে ধরলো।ফিরোজের ছোঁয়া অনুভব করতেই আরজুর যেন নিজের শরীরের উপর ঘৃণা জন্মালো।হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো তবে ফিরোজের শক্তির সাথে ঠিক পেরে উঠলো না।
“হাত ছাড় ফিরোজ।”
ফিরোজের অভিব্যক্তি বদলেছে।চোখেমুখে তার লেপ্টে আছে এক অদ্ভুত মুগ্ধতা।আরজুর প্রতি মুগ্ধতা।হাতের বাঁধন তার শক্ত হলেও কন্ঠটা ভীষণ নরম শোনালো এবার।
“স্বেচ্ছায় আমার হয়ে যা আরজু।খোদার কসম ভালো হয়ে যাবো।তুই যা বলবি তাই শুনবো।তুই আমায় ভালোবেসে কাছে টানলে এই ফিরোজ তোর পায়ের কাছে বসে থাকবে।”
আরজুর মাঝে বিশেষ কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না।তাচ্ছিল্য ভরা গলায় বলল,
“তোর মতন জানোয়ারের জায়গা এমনিতেই পায়ের কাছেই হয়।আমিও তোকে বলছি,খোদার কসম তুই আমাকে নিজের বউ হিসেবে কখনোই পরিচয় করাতে পারবি না।”
ফিরোজ এবারে আরজুর হাতটা ছেড়ে দিল।শব্দ করে হেসে উঠলো।এই মূহুর্তে ফিরোজের হাসিটা আরজুর কাছে স্বাভাবিক লাগলো না।ফিরোজ হাসতে হাসতেই আরজু কে বলল,
“তুই আমাকে ভালো হতে দিলি না।বললাম তোকে আমার হয়ে যা সব ছেড়ে দেব।আমি জানি আমি কতটা নিকৃষ্ট কিন্তু তোকে ভালোবাসি আমি।তুই শুধরে দিবি না তো আমায়,ঠিক আছে।তবে তোকে আমায় এই রুপেই গ্রহণ করতে হবে।মিলিয়ে নিস আমার কথা।”
_______
“বিয়ে দেওয়ার জন্য তোমরা ওই ৪০ বছরের বুড়োকেই খুঁজে পেলে মা?ওর বউ ওকে ছেড়ে গেছে,ওর একটা বাচ্চা আছে আর কাউকে পেলে না তোমরা?”
আরজুর এতগুলো কথার প্রেক্ষিতে ওর মা নাসিমা শান্ত কণ্ঠে বলল,
“তোমার বোন এমন কোন ভালো কাজ করেনি যে ওর জন্য এর থেকেও ভালো পাত্র খুঁজে পাব।আর এই ছেলের মাঝে তো আমি কোন দোষ খুঁজে পাচ্ছি না।”
আরজু তাচ্ছিল্য ভরা কণ্ঠে বলল,
“খুঁজে পাবে কি করে?তোমাদের ঘাড় থেকে বোঝা নামিয়ে ফেলতে পারছো এটাই তো তোমাদের জন্য যথেষ্ট।মেয়ের বিয়ে দিতে পারলেই বেঁচে যাও কিন্তু আদৌ সেখানে সে ভালো থাকবে কিনা এই নিয়ে কোনো মাথা ব্যথাই তোমাদের মাঝে নেই।এর থেকে তো জন্মের পর একেবারে গলা টিপে মে/রে ফেলতে পারতে মা।”
কথাটা বলার সাথে সাথে নাসিমা ঘুরে ওর গালে ঠা/স করে একটা চ/ড় বসালো।মেয়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
“কিছু বলি না জন্য দিন দিন তোমার সাহস বেড়ে যাচ্ছে।তোমাদেরকে জন্ম দিয়েছে আমি,এত বছর কষ্ট করে মানুষ করেছি। কৃতজ্ঞ থাকো।”
“জন্ম যখন দিয়েছিলে তাহলে আমাদেরকে মানুষ করা তোমার কর্তব্য ছিল।অবশ্য মানুষ তো করতে পেরেছো আমাকে আর আপাকে।ছেলেকে তো কুলাঙ্গার বানিয়েছো।তবুও ওই জা/নো/য়া/রের প্রতি তোমাদের ভালোবাসা কমে না।আহহ..”
কথা বলার মাঝেই আরজু ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করলো।পিছন থেকে কেউ একজন খুব শক্ত করে আরজুর চুলের মুঠিটা ধরেছে।ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই নিজের বড় ভাই প্রিথুল কে দেখতে পেল যে কিনা কটমটে দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।আরজু ব্যথাতুর কন্ঠে বলে উঠল,
“ভাইয়া ছাড়ো লাগছে আমার।”
“লাগার জন্যই তো ধরেছি।আমি কুলাঙ্গার তো তুই নিজে কি?শহরে গিয়ে দু'চারটে ইংরেজি শিখে নিজেকে খুব বড় মনে করা শুরু করেছিস তাই না?সত্যি করে বলতো কি করিস তুই ওখানে?বাড়ি থেকে তো টাকা নিস না তাহলে নিজের খরচ চালাস কি করে?”
প্রিথুলের করা নোংরা ইঙ্গিতে আরজুর গা ঘিনঘিন করে উঠলো।ভাবতে লজ্জা লাগে যে এই নোংরা মস্তিষ্কের মানুষটা ওর নিজের মায়ের পেটের ভাই।এদিকে নাসিমা ছেলেকে ইশারা করতেই অগত্যা প্রিথুল কে আরজু কে ছাড়তে হলো।ছাড়া পেয়ে আরজু ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
“নিজে কষ্ট করে উপার্জন করে সেই টাকা দিয়ে নিজের খরচ চালাই।এছাড়া তো আর কোন উপায় নেই আমার কাছে।আর ভুলে যেও না আমি টাকা নেই না কারণ এই বাড়ি থেকে আমাকে কোন টাকা দেওয়া হয় না।”
“তোর জেদ মেটানোর জন্য অযথা আমরা টাকা নষ্ট করতে যাব কেন?কতবার করে বললাম যে ফিরোজকে বিয়ে করে নে,কিন্তু না ভালো তো তোর সহ্য হবে না।শহরে গিয়ে ছেলেদের সাথে ঢলাঢলি করবি সেটাই তোর পছন্দ।”
“খবরদার ভাইয়া আমার চরিত্রের উপর আঙ্গুল তুলতে আসবে না।তুমি নিজে চরিত্রহীন জন্য সবাইকে তোমার মতন ভেবো না।আর ভালো করতে চেয়েছিলে আমার তাই না?ওই ফিরোজের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিল?ও তো তোমার মতনই বখাটে,বেকার,অমানুষ,চরিত্রহীন।এটাই আমার ভালো করার নমুনা?”
প্রিথুল নাসিমা কে বলল,
“ওকে চুপ করতে বলো মা।এবার কিন্তু আমার হাত উঠে যাবে।”
আরজু ছলছল নয়নে নিজের মায়ের দিকে তাকালো।ধীর কণ্ঠে বলল,
“তোমার সামনে আমাকে এত বাজে বাজে কথা বলছে তারপরেও তুমি ওকে কিছু বলবে না মা?একটুও কি ভালোবাসো না আমায় তুমি?”
নাসিমা গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“সে তো তুমিও নিজের বড় ভাইকে কম বাজে কথা শোনাওনি।এখন আর এই নিয়ে কোন কথা হোক আমি চাইনা।চুপচাপ ঘরে যাও। প্রিথুল বাবা তুমিও যাও।”
প্রিথুল ঘরে চলে গেল।আরজু দু হাতে নিজের চোখের জল মুছে নাসিমা কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“জন্ম তুমি আমাদের তিনজনকেই দিয়েছো কিন্তু মা হয়ে উঠতে পেরেছে শুধুমাত্র নিজের ছেলের।”
_____
হনহন করে নিজের রুমে ঢুকে ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিল আরজু।বিছানায় আর বসলো না,সোজা বারান্দায় প্রার্থনার কাছে গেল।
গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে প্রার্থনা।দেখে মনে হচ্ছে খুব গভীর ভাবনায় নিমগ্ন সে।আরজুর কর্কশ কন্ঠে তার ভাবনার মাঝে ছেদ ঘটলো।
“এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে কিছু হবে না।এই বিয়েটা করে কি প্রমাণ করতে চাইছো আপা যে তুমি বাবা মায়ের খুব বাধ্য মেয়ে?কোন লাভ নেই এসব করে।শুধু তোমার জীবনটা শেষ হয়ে যাবে।”
প্রার্থনা মলিন হেসে আরজুর দিকে তাকালো। চোখে মুখে তার অসহায়ত্বের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।মলিন কন্ঠে আরজু কে বলল,
“আমার জীবন শেষ হওয়ার কি বাকি আছে?একবার আমাকে ভালো করে দেখে বলতো তোর কি মনে হচ্ছে যে আমি বেঁচে আছি?জীবন্ত লা/শের মতন লাগছে না আমায়?”
আরজুর দুচোখ ছলছল করে উঠলো।জরানো কণ্ঠে বলল,
“এই বিয়েটা তোমায় করতে হবে না আপা। তুমি আমার সাথে ঢাকায় চলো।আমি তোমার সব খরচ চালাবো।দরকার পড়লে দুই বোন এক বেলা না খেয়ে থাকবো তাও তোমায় এই অশান্তির মাঝে আমি থাকতে দেব না।”
প্রার্থনা আরজুর গালে হাত রেখে বলল,
“তুই যে ছোট হয়ে নিজের বড় বোনের দায়িত্ব নিতে চেয়েছিস এটাই অনেক।কিন্তু আমি তোর মাথার উপর এত বড় একটা দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে পারবো না।বিয়েটা আমায় করতেই হবে।”
“কেন এমন করছো আপা?আচ্ছা ঠিক আছে আমি তোমাকে টিউশনের ব্যবস্থা করে দেব। তুমি নিজের খরচ নিজেই চালাবে।বাড়িতে কাউকে কিছু জানাবো না।আজ রাতে দুজন পালিয়ে ঢাকা চলে যাব।আর আপত্তি করো না আপা।”
প্রার্থনা দুহাতে জড়িয়ে ধরল আরজু কে।এই বাড়িতে হয়তো একটা মাত্র মানুষই প্রার্থনার কথা ভেবেছে বাকিরা কেউ ভাবেনি।অবশ্য যেখানে নিজের মা ই ভাবছেনা অন্যদের থেকে আশা করাই ভুল।
“এমনিতেই আমার জন্য বাবার অনেক সম্মানহানি হয়েছে।অনেক কষ্টে একটা বিয়ে ঠিক করেছে না হলে কেউ তো আমায় বিয়ে করতেই চাইছিল না।আমি চাইনা আর আমার জন্য নতুন করে কোন অশান্তি হোক। ভালোবেসে এমনিতেই আমি মৃত প্রায়।এবার না হয় শুধু আয়োজন করে আমার সমাধির ব্যবস্থা করা হবে।”
“তারমানে তুমি আমার সাথে যাবে না তাইতো?”
“আমার জীবনে নতুন করে শুরু করার মত আর কিছুই অবশিষ্ট নেই তাহলে কিসের আশায় যাবো তোর সাথে?তুই আমার চিন্তা বাদ দে,নিজের জীবনের চিন্তা কর।আমি চাইনা আরু আমার জীবনের মত তোর জীবনটাও শেষ হয়ে যাক।তোর জীবনের এত সংগ্রাম,এত কষ্ট সব যে তাহলে ব্যর্থ হয়ে যাবে রে।আর তোর সাথে এই ব্যর্থ শব্দটা একদমই মানানসই না।”
“আমি তোমায় বলেছিলাম আপা ভালোবাসা বলতে কিছু নেই।সব দু চার দিনের মোহ।মোহ কেটে গেছে আর তোমাকে একা রেখে চলে গেছে।ভালোবাসা মানে ধ্বংসের শুরু আর ঠিক এই ভুলটার জন্য আজ তোমার এত কষ্ট।”
প্রার্থনা স্মিত হেসে বলল,
“যদি সত্যিই ভালোবাসো বলতে কিছু না থাকতো তাহলে তো আজ আমিও তাকে ভুলে অন্য পুরুষ কে আপন করে নিতাম।শুধু মোহ কি আর এতদিন থাকে?ভালোবাসা আছে জন্যই আমি আজও সেই মানুষটাকে ঘৃণা করতে পারি না।ভালোবাসা আছে জন্যই আমি আজও তার দেয়া ফুল যত্ন করে ডায়েরির ভাজে রেখে দিয়েছি।ভালোবাসা আছে জন্য আজও তার কথা মনে করে মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়।দেখ না ভালোবাসা আছে জন্যই আমি এখনো তার কথা ভাবছি আর হাসছি।”
আরজুর চোখ মুখে কাঠিন্যতার ছাপ ফুটে উঠল।কন্ঠে একরাশ ঘৃণা সমেত বলল,
“ভালোবাসার অস্তিত্ব যদি এতটাই স্পষ্ট হয় তাহলে কোথায় হারিয়ে গেল তোমার সেই প্রেমিক?যদি ভালোবাসা থেকেও থাকে তাহলে এমন ভালোবাসাকে আমি ঘৃণা করি যা কেবল কষ্টই দিতে জানে।”
_____
শীতের সকাল।বাইরে কুয়াশায় কিছু পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে না।খোলা জানালা দিয়ে বাড়ির পাশের ফুলের গাছগুলো থেকে হালকা মিষ্টি সুবাস ভেসে আসছে।ঘড়িতে তখন সকাল আটটা বেজে পনেরো মিনিট।এমনি দিনে গ্রামের বাড়িতে এই সময়টাকেই অনেক বেলা মনে হয় কিন্তু আজকে তেমন কোলাহলের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।এর অবশ্য দুটো কারণও আছে।আজ শুক্রবার।বাড়ির কর্তাদের কাজে যাওয়ার ঝামেলা নেই ফলে গৃহিণীদেরও আর সকাল-সকাল রান্নাবান্না শেষ করে তাদের কর্তাদের খাবার পরিবেশনের তাড়া নেই।তার উপর আবার ঠান্ডা।যে যার ঘরে হয়ত কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে।
বাইরে থেকে মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল আরমানের।অনিচ্ছা সত্ত্বেও গায়ের কম্বলটা সরিয়ে আরমোরা ভেঙে উঠে বসলো।জানালা দিয়ে বাইরের পরিবেশটা দেখতেই আরমানের মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠলো।সঙ্গে সঙ্গে শীতল বাতাসে আরমানের গা শিউরে উঠলো।তৎক্ষনাত আবার কম্বলটা তুলে গায়ে জড়ালো।শীতকাল আরমানের বেশ পছন্দ।তবে আজকাল কেন যেন তার শীতকালের থেকেও বর্ষাকাল একটু বেশি ভালো লাগছে।বর্ষার বৃষ্টির কথা ভাবলেই মস্তিষ্কে কিছু দৃশ্য ভেসে ওঠে।ফিরে যেতে ইচ্ছে করে আবার ঠিক সেই মুহূর্তটাতে।আর ইচ্ছে করে সময়কে থামিয়ে দিয়ে এক দৃষ্টিতে সেই নাম না জানা রমণীর দিকে তাকিয়ে থাকতে।
আরমান কম্বল মুড়ি দিয়ে আবারও শুয়ে পড়লো।তবে এবারে উদ্দেশ্য ঘুমোনো নয় বরং কাউকে মনে করা।
অতীত….
এক বন্ধুর আবদারে একটা পার্কে এসেছে আরমান।সচরাচর এদিকে তার আসা হয় না কিন্তু আজকে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের অনুরোধে তাকে আসতেই হয়েছে।একটা বেঞ্চের উপর বসে আছে আরমান কিন্তু সেই ছেলের দেখা নেই।ফোনটাও ধরছেনা। এদিকে আকাশের অবস্থাও ভালো না।যেকোনো সময় ধরণী তে বৃষ্টি নামবে। গাছপালাগুলোও খুশিতে মেতে উঠেছে।বাতাসের কারণে ধুলো উড়ছে।এরই মাঝে আরমান খেয়াল করল দু একফোঁটা করে বৃষ্টি পড়াও ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে।আর বসে থাকলে আরমানকে আজ কাক ভেজা হয়ে বাড়ি ফিরতে হবে সেটা আন্দাজ করতেই উঠে দাঁড়ালে যাওয়ার জন্য।মনে মনে হাজারটা গালি দিল নিজের বন্ধু কে।সাথে প্রতিজ্ঞা করলো যে আর কোনদিন বন্ধুর ডাকে এই জায়গাতে আসবে না।
আরমানের এসব ভাবনার মাঝেই তুমুল বেগে বৃষ্টি শুরু হলো।আশেপাশে যে দু একজন মানুষ অবশিষ্ট ছিল তারাও একটা ছাউনির আশায় ছুট লাগাল।ওদের পিছু পিছু আরমানও ছুট লাগাতে নিল কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের বৃষ্টিতেই সে প্রায় ভিজে গেছে।ফলস্বরূপ কোন ছাউনির নিচে যাওয়ার জন্য তার মাঝে আর কোন তাড়া দেখা গেল না।বৃষ্টিটা উপভোগ করতে লাগলো।
হুট করে কানে একটা মিষ্টি গলার গানের আওয়াজ ভেসে এলো আরমানের।কিন্তু আশেপাশে তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না।এবার মনোযোগ দিয়ে কণ্ঠের উৎপত্তিস্থল খোঁজার চেষ্টা করলো।আশেপাশে তাকালো কোন ছাউনিও নেই তাহলে বৃষ্টির মাঝে কোন পা/গল গান গাইছে?
ব্যাপারটা জানার জন্য ভীষণ কৌতুহল তৈরি হলো আরমানের মনে।কিন্তু এখন আর গানের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না।আরমান বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে ফেলল।মিনিট খানেকের ব্যবধানে আবারো আরমানের কানে সেই একই কন্ঠটা ভেসে এলো,
❝আজ ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে,
জানিনে জানিনে কিছুতে কেন যে,
মন লাগে না,
ঝরঝর মুখর বাদল দিনে!❞
আশেপাশে তাকাতে আরমান ডান দিকে গাছপালার ডালের ফাঁকফোকর ভেদ করে কালো চুড়িদার পড়া এক জোড়া পা দেখতে পেল।লম্বা একটা সারি ধরে পার্কের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে।ফলে গাছগুলো ভেদ করে রমণীকে দেখতে পেল না আরমান।সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে অপর পাশে গেল।এদিকটাতে যে দোলনা আছে সেসব আরমানের জানা ছিল না।অবশ্য জানবেই বা কি করে আজই তো প্রথম এসেছে এখানে।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে প্রায়ই কারো খোঁজে আসতে হবে।কালো সালোয়ার কামিজ পড়ে একটা মেয়ে দোলনায় বসে একাই দোল খাচ্ছে।দোলনার গতি কমে গেলে নিজেই আবার কষ্ট করে গতি বাড়ানোর চেষ্টা করছে।আপনমনে গান গাইছে সে।চুলগুলো ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে।কপালে পরে থাকা চুল বেয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে।গায়ের রং ফর্সাও না আবার কালোও না,ঠিক শ্যামলাও বলা চলে না।তবে দেখে মনে হচ্ছে একটু যত্ন নিলে তাকে ফর্সাদের তালিকায় রাখা যায়।মুখের দু তিন জায়গায় তার ব্রণের দাগ, নাকের ঠিক উপরে একটা কালো তিল। মেয়েটা যে দেখতে খুব সুন্দর তেমন না তবে সুন্দর।এবং যতটুকু সুন্দর তাতেই আরমানের দৃষ্টি থমকাতে বাধ্য।
মেয়েটা আশেপাশে কারো উপস্থিতি এখনো খেয়াল করেনি।অবশ্যই না করারই কথা।সে তো চোখ দুটো বন্ধ করে আপন মনে গান গাইছে।আরমানও আলাদা করে কোন শব্দ করে নি যার দরুন মেয়েটা তার উপস্থিতি লক্ষ্য করবে।এদিকে বৃষ্টি আর বাতাস দুটোর বেগই ক্রমশ বাড়ছে।ক্ষণে ক্ষণে আবার মেঘের গর্জনের আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে।আরমানের খুব করে ইচ্ছে করছে মেয়েটার সাথে কথা বলতে কিন্তু কিভাবে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না।অনেক ভেবে সাহস সঞ্চয় করে বলেই ফেলল,
“মনটা বোধহয় অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছেন সেজন্য আর কিছুতেই লাগছে না সেটা।কিংবা হয়ত কোনো অসুখে মনটা ম/রে গেছে।ঠিক বললাম তো?”
অপরিচিত পুরুষালী কোন কণ্ঠস্বর কানে যেতেই আরজুর গানের গলা থেমে গেল।ওড়না দিয়ে মাথাটা ঢেকে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই পিছন থেকে আরমান বলে উঠলো,
“প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই চলে যাচ্ছেন?”
আরজু ফিরে তাকালো না।গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমার মনের খবর জানাতে পারি এমন পরিচিত কিংবা গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আপনি নন।তবে এতোটুকু বলতে হচ্ছে আপনার আগমন না ঘটলে আমার মনটা সত্যি ভালো হয়ে উঠতো।”
“শুকরিয়া করুন যে আমার আগমন ঘটেছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখেছেন একবার যে আদৌও কেউ আছে কিনা?এই পুরো জায়গাটা খালি।এসব জায়গা একটা একলা মেয়ের জন্য নিরাপদ না।”
“আমার প্রতিদিনের বিশ্রামের জায়গা এটা।আশপাশটা সম্পর্কে ধারণা আছে আমার। খারাপ কিছু কখনো খেয়াল করিনি কিংবা শুনিনি।”
“বিপদ কিন্তু বলে আসেনা।”
“যেমন আপনি?”
আরজুর এমন প্রশ্নে আরমান থতমতো খেল।মেয়েটা একটু বেশিই স্পষ্ট কথা বলে।
“আমাকে আপনার বিপদ মনে হচ্ছে?”
“হতেই তো পারেন।”
“তাহলে কি আপনাকে সাবধান করতাম আমি?”
“হয়তো ভালো সাজতে চাইছেন?”
“কিন্তু এমনটা আমি কেন করতে চাইবো?”
“যে কারণে আগ বাড়িয়ে আমার সাথে কথা বলতে এসেছেন সেই কারণে।”
আরমান বুঝল এই মেয়ের সাথে সে যুক্তিতে পেরে উঠবেনা।অগত্যা অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে বলল,
“আপনার নামটা জানতে পারি কি?”
আরজু স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“না।আল্লাহ হাফেজ।”
কথাটা বলে আরজু আর সেখানে এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না।চোখের পলকেই সে চলে গেল
আরমান যেন এখনো একটা ঘোরের মাঝে আছে।মেয়েটা বড্ড ঠাস ঠাস করে প্রতিটা কথার উত্তর দিয়ে দেয়।এতগুলো কথা বলল অথচ একটা বারের জন্য আরমানের মুখের দিকে তাকালো না।কোন আগ্রহই নেই।তবে এত কিছুর মাঝে একটা কাজের কাজ হয়েছে।আর তা হলো আরমান জানতে পেরেছে যে আরজু প্রতিদিন এখানে আসে।এখন মনে হচ্ছে আরমানকেও নিয়ম করে এই জায়গায় আসতে হবে।
বর্তমান….
পুরনো কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আবারো ঘুমিয়ে পড়েছিলো আরমান।আর এবার বাইরে থেকে মায়ের ডাকের পাশাপাশি দরজায় জোরে জোরে করাঘাতের আওয়াজও হলো।এত জোরে আওয়াজ কানে যেতেই আরমান ধরফরিয়ে উঠে বসলো।কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিল।স্বাভাবিক হতেই তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল।দরজা খুলতেই আমেনা বেগম মৃদু রাগী কন্ঠে বললেন,
“সেই কখন থেকে ডাকছি তোকে খেতে আসার জন্য।এত বেলা অব্দি কিসের ঘুম?খাওয়ার টেবিলে তোর বাবা অপেক্ষা করছে তোর জন্য।তাড়াতাড়ি আয়।”
কথাটা বলে আমেনা বেগম চলে গেলেন।তিনি যেমন ঝড়ের গতিতে এসেছিলেন ঠিক তেমনি ঝড়ের গতিতেই চলে গেলেন।আরমান আর কিছু না ভেবে হাত মুখ ধুঁয়ে খেতে চলে গেল।
চলমান।

No comments