তোর পিরীতে পাগল হইলাম রে
তোর পিরীতে পাগল হইলাম রে
পর্ব_৪
লন্ডভন্ড করে ফেলেছে।প্রার্থনা বারবার করে বলছে যে আরজু নেই ঘরে কিন্তু ফিরোজ যেন মানতেই চাইছে না।বাইরে খুঁজে তো আরজু কে পায়নি তাহলে আর যাবে কোথায়?নিশ্চয়ই আরজু এত সাহসী না যে পালাবে।
দরজার কাছে নাসিমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছেন সবটা।তার মুখের অভিব্যক্তি দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না যে তার মনের ভেতরে কি চলছে।তিনি ফিরোজকে আটকাচ্ছেনও না আবার প্রার্থনা কে কাঁদতে দেখে সান্ত্বনাও দিচ্ছেন না।
খুঁজতে খুঁজতে ফিরোজ এবার সত্যি আশাহত হলো।ও জানে আরজু নেই তাও খুঁজছে।মাথায় যেন র/ক্ত চড়ে বসেছে।কোণার দিকে দাঁড়ানো প্রার্থনার দিকে তেড়ে গিয়ে এক হাতে চোয়াল চেপে ধরে বলল,
“সত্যি করে বল প্রার্থনা আরজু কোথায়?ও নিশ্চয়ই গ্রাম ছেড়ে বের হতে পারেনি।বের হলে আমার লোকেরা দেখত।সত্যি করে বল ওকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস?”
প্রার্থনা ক্রন্দনরত গলায় বলল,
“সত্যি বলছি ফিরোজ ভাই আমি জানিনা আরু কোথায়।ও কখন বেরিয়ে গিয়েছে আমি সেটাও জানি না।আমায় কিচ্ছু বলে যায়নি ও।”
“আমাকে তোর ভাই পাসনি যে তোর এসব কথা বিশ্বাস করে নেব।আমি জানি আরজু কোথায় গিয়েছে তুই জানিস।ঠিকানা বল?ও কোন ভার্সিটিতে পড়ে নাম বল?ও যেখানে আছে আজকে সেখান থেকে ওকে খুঁজে বের করে তুলে এনে বিয়ে করবো।”
“আমি জানিনা ও কোথায় আছে।ও কোন ভার্সিটিতে পড়ে আমি এসব কিছু জানি না বিশ্বাস করো?ও কখনো আমাকে কিছু বলেনি এসব বিষয়ে।”
প্রার্থনা কথাটা বলার সাথে সাথে ফিরোজ ওকে এক প্রকার ছুঁড়ে মা/রলো।পিছনের দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেল প্রার্থনা।আর্তনাদ করে উঠলো।ফিরোজের বোধহয় এতে ভালোই লাগলো।দাঁত পিষে বলল,
“আমি খুঁজে নেব ওকে।”
ফিরোজের চোখ পড়লো এবার আরজুর ব্যাগের ওপর।ব্যাগটা খুলে একে একে তার ভেতরে থাকা সবকিছু বের করলো।সবশেষে একটা কাগজের টুকরো পেল,বাসের টিকিট।যেখানে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ঢাকার বাসের টিকিট।ফিরোজ কপাল কোঁচকালো।ঢাকার বাসের টিকিট আরজুর ব্যাগে কি করছে এই ব্যাপারটা যেন ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না।ওর জানা মতে আরজু চট্টগ্রামে থাকে।বেশ কয়েকবার গ্রাম থেকে ফেরার সময় চট্টগ্রামের বাসেই উঠতে দেখেছে তাহলে ঢাকা কি করতে গিয়েছিল?
আরো একবার তেড়ে গেল প্রার্থনার দিকে
তবে এবার নাসিমা সামনে এসে দাঁড়ালো।
শান্ত গলায় বলল,
“সামনে আমার মেয়েটার বিয়ে ফিরোজ।আঘাত করিস না ওকে।”
“আঘাত করলেই কি?বিয়ে তো আমার ভাইই করবে।সামনে থেকে সরে দাঁড়াও তুমি।ওর এক ঠ্যাং না থাকলেও আমার ভাইই ওকে বিয়ে করবে।”
“তাই বলে এভাবে ওর গায়ে হাত দিতে পারিস না তুই।”
ফিরোজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
“আমার ভাইয়ের বউ হওয়ার পরে দরকার পড়লে ওর উপরে ভাগও বসাতে পারি।আমি কি কি করতে পারি সেসব কি তোমায় আবার নতুন করে বোঝাতে হবে?সামনে থেকে সরো।”
“তোর চাচা যদি শোনে যে তুই ওর গায়ে হাত তুলেছিস তাহলে কিন্তু রেগে যাবে।আমি কি ডাকবো?”
ফিরোজ খুব কষ্টে নিজের রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করলো।নাসিমার পিছনে থাকা প্রার্থনা কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ও যদি চট্টগ্রাম থাকে তাহলে ওর ব্যাগে ঢাকার টিকিট কি করছে?”
প্রার্থনা তৎক্ষণাৎ একটা অজুহাত বের করে বলল,
“আরজু এবার ঢাকা থেকে ফিরেছে।ঢাকা তে ওর বন্ধুর বিয়ে ছিল সেজন্য ওখানে গিয়েছিল।”
“নাম কি বন্ধুর?কোথায় থাকে সে বন্ধু?”
“আমি জানিনা।”
“শোন প্রার্থনা দুদিন পর কিন্তু তোকে আমাদের বাড়িতেই উঠতে হবে।তখন তোকে বাঁচানোর জন্য সামনে কেউ দাঁড়াবেনা,এমনকি আমার ভাইও না।যদি কখনো জানতে পেরেছি যে তুই কোন কিছু জেনে বুঝে আমার থেকে লুকিয়েছিস মনে রাখিস সেদিন তোর অবস্থা খারাপ হবে।”
ফিরোজ চলে গেল।ওর পিছু পিছু নাসিমাও বেরিয়ে চলে গেলেন।মেয়েকে কোনরকম কোন সান্ত্বনা দিলেন না,কতটা কি আঘাত পেয়েছে সেসব কিছুও জিজ্ঞেস করলেন না।
_________
মাঠের একপাশে আরজু কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মুনতাসির।প্রচারণার কাজে বেরিয়ে ছিল।মেয়েটা সব সময় একাই থাকে,আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না।মুনতাসির এগিয়ে গেল আরজুর দিকে।ওকে আরজুর দিকে এগিয়ে যেতে দেখে অনেকগুলো বিস্ময় ভরা দৃষ্টি ওদের উপরে পরলো।অনেকেই এগিয়ে আসে মুনতাসিরের সাথে কথা বলার জন্য তবে মুনতাসির কখনো তাদের সাথে খুব বেশি কথা বলতে পছন্দ করেনা।হ্যাঁ,প্রয়োজন অনুযায়ী কথা বলে।তবে নিজ থেকে এগিয়ে গিয়ে অযথা কারো সাথে গল্পে মেতে ওঠে না।আরো একটা ব্যাপার,কখনো কারো চোখের দিকে তাকিয়ে সে কথা বলে না।কথা বলার সময় সব সময় তার তার দৃষ্টি থাকে নিচের দিকে।
“আরজু!”
ডাকটা কানে যেতেই আরজু চোখ তুলে তাকালো।মুনতাসির কে দেখে তার অভিব্যক্তি কি হওয়া উচিত বুঝে উঠতে পারল না।আরজু কে নিজের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুনতাসির নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে বলল,
“কি করছিলে এখানে একা দাঁড়িয়ে?”
এই উত্তরটা বোধহয় আরজু নিজেও জানে না যে ও এখানে দাঁড়িয়ে কি করছে।তবে হ্যাঁ কিছু ভাবছিল।গ্রামে প্রার্থনার কি অবস্থা এই বিষয়টা এক মুহূর্তের জন্যও আরজু কে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না।আরজুর থেকে আবারও কোন উত্তর না পেয়ে মুনতাসির আবারো নিজেই বলে উঠলো,
“কোন সমস্যা কি?”
“না তেমন কোন ব্যাপার না।আপনি কি কিছু বলবেন?”
“না।তোমাকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম তাই এলাম।শিফট করছো কবে নতুন হোস্টেলে?”
“আজ বিকেলে করব।সমস্যা হবে না তো?”
“না কোন সমস্যা হবে না।তোমার যে রুমে থাকার ব্যবস্থা করেছি ওই রুমে আমার কাজিনও থাকে।কোন সমস্যা হলে ওকে বলবে কেমন?ও আমায় জানিয়ে দেবে।তুমি যদি চাও নিজ থেকেও আমাকে জানাতে পারো কিন্তু তুমি তো জানাবে না সেজন্যে এই উপায়টা বললাম।”
“আচ্ছা আমি এখন আসছি।”
মুনতাসির হালকা হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় জানাতেই আরজু চলে গেল।মেয়েটার একটা ব্যাপার মুনতাসিরের খুব ভালো লাগে।অতিরিক্ত কোন কথা বলে না।সাহায্য করার জন্য ঠিক যতোটুকু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা দরকার কৃতজ্ঞতাটুকু তার থেকে বেশি প্রকাশ করে না।সবকিছু পরিমাণ মতো করে।মেয়েটা সত্যি আলাদা।
মুনতাসির আবার নিজের কাজে চলে যেতে ধরলে কোথা থেকে যেন এক প্রকার ছুটে আরমান এলো।দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে দৌড়ে এসেছে।তবে আরমান আসতে আসতে আরজু সেখান থেকে চলে গেছে।
“হামিদ এর সাথে কোনো ঝামেলা করেছো?”
“না তো।”
আরমান কিঞ্চিৎ রাগী গলাতেই বলল,
“ভালো করে মনে করো ছেলে?কোন মেয়ের জন্য নাকি ঝামেলা বাঁধিয়েছো?এই আমি তোমার আদর্শ?আমাকে দেখেছো কখনো এসব রাজনীতির মাঝে বন্ধুবান্ধব কিংবা পরিবারের লোকজনদের জড়াতে?আর এখানে তো সোজা নিজের দুর্বল জায়গাটাই দেখিয়ে দিয়েছো।এসব বোকামো কেউ করে?”
“আপনি ভুল ভাবছেন ভাই।হ্যাঁ এটা ঠিক ওই মেয়েটা আমার দুর্বলতা তবে আপনি যেমন দুর্বলতা ভাবছেন তেমন দুর্বলতা না।”
আরমান কপাল কুঁচকে মুনতাসিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তাহলে কেমন দুর্বলতা?”
“অন্যদিন বলি?তবে কি হয়েছে সেটা বলুন?”
“এত জেনে লাভ নেই তোমার।নিজে সাবধানে থেকো আর যার জন্য ঝামেলা করেছো তাকেও সাবধানে রেখো।আমি তো তোমায় বুদ্ধিমান ভেবেছিলাম এখন মনে হচ্ছে তুমি খুবই বোকা।এই বুদ্ধি নিয়ে রাজনীতিতে আসা ঠিক হয়নি।ঝামেলা করেছিলে কবে?”
“সে তো অনেক আগে,বেশ কয়েক মাস হতে চললো।”
আরমানের কপালের মাঝে গাঢ় ভাঁজ সৃষ্টি হলো।নিজেই বিড়বিড় করে বলল,
“এতদিন আগের রাগ এত দেরিতে ঝাড়ছে কেন?”
“কিছু বললেন ভাই?”
আরমান মুনতাসিরের দিকে তাকালো।কি চমৎকার ভাবে হাসছে ছেলেটা।ঠোঁট দুটো হালকা একটু প্রসারিত হয়েছে।গাঢ় বাদামি রঙের পাঞ্জাবি আর মাথায় কালো টুপি।কি অপূর্ব লাগে ছেলেটা কে দেখতে।চেহারার মাঝে কেমন যেন একটা নিষ্পাপ ভাব রয়েছে।আরমানের কেন যেন আফসোস হচ্ছে এটা ভেবে যে মুনতাসির কেন রাজনীতি তে জড়িয়েছে।
আরমান কে চুপ করে থাকতে দেখে মুনতাসির ডেকে উঠলো।
“কিছু ভাবছেন ভাই?”
“না কিছু ভাবছিনা।রাতে দেখা করো তো আমার সাথে।কিছু বোঝানোর আর শেখানোর আছে তোমায়।আর একটা কথা বলি মনোযোগ দিয়ে শোনো,আমাকে দেখতে যতটা ভালো মনে হয় আমি কিন্তু ততটা ভালো না।আগে আমাকে পুরোপুরি জানো তারপরে আমার মতন হওয়ার চেষ্টা করো।তুমি বড্ড ভালো ছেলে।তোমার এসবে জড়ানো ঠিক হয়নি।”
মুনতাসির আলতো হেসে বলল,
“এসব কথা বাদ দিন।আজ রাতে যখন দেখা করতে বললেনই তাহলে সাক্ষাৎকারটা আমার বাড়িতে হোক?আসলে আমার মায়ের কাছে আপনার অনেক গল্প করেছি।মা আপনাকে দেখতে চেয়েছে একবার।আবার আজকে আমার ছোট বোনের জন্মদিনও। কাউকে ডাকিনি শুধু আপনাকে বললাম।আসতে পারবেন ভাই?”
“তোমার মা দেখতে চেয়েছে?”
“জ্বী।”
“মায়ের আবদার আর কি করে ফেলি বলো?ঠিক আছে যাবো।”
“ধন্যবাদ ভাই।”
আরমান চলে যেতে নিয়ে আরো একবার থেমে গেল।পিছন ফিরে তাকিয়ে আরো একবার মুনতাসিরকে সতর্ক করে বলল,
“ঝামেলা যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলবে।হামিদ দলের পুরনো লোক।আর তুমি নতুন।আর মেয়েটাকেও সাবধানে রেখো।তোমার থেকে নেওয়ার মতন শুধুমাত্র তোমার জীবনটাই আছে আর ওই মেয়ের থেকে নেওয়ার মতন ওর জীবন,মান দুটোই আছে।সাবধানে থেকো আর ওকে সাবধানে রেখো।”
মুনতাসির আরো একবার মুগ্ধ হলো আরমানের ব্যবহারে।মুনতাসির জানে ওর বিপদের আশঙ্কা পেয়েই আরমান এভাবে ছুটে এসেছিল দেখতে যে ও ঠিক আছে কিনা।কি সুন্দর উপদেশ দিয়ে গেল।সুন্দরভাবে বুঝিয়ে গেলে যেন ঝামেলা এড়িয়ে চলে।মুনতাসির আরো একটা মানুষকে খুঁজে পেল যে নিঃসন্দেহে যে কাউকে খুব তাড়াতাড়ি মুগ্ধ করতে পারে নিজের আচরণের দ্বারা।মুনতাসির বলতে বাধ্য যে আরজুর মতো এই মানুষটাও সবার থেকে আলাদা।
____
আজকের দিনের মত নিজের রাজনৈতিক জীবনের পাঠ চুকিয়ে আবারও একটা সাধারণ মানুষের মতন পার্কে এসে কোন এক রমণীর অপেক্ষা করছে আরমান।আজকে ঠিক করেছে যে যতক্ষণ না সেই মেয়ে কে দেখতে পাবে যাবে না এখান থেকে।আরমানের বারবার কেন যেন মনে হচ্ছে যে ও যাকে খুঁজছে সেই মানুষটা রোজ এখানে আসে শুধু আরমান দেখতে পায় না।তাই ঠিক করেছে আজ কোন মতেই আরজু কে না দেখা পর্যন্ত যাবে না।
দীর্ঘ একটা সময় বেঞ্চের ওপরে বসে থাকলো।তারপরে উঠে দাঁড়ালো।ভাবলো সেখানে যাবে যেখানে প্রথম দিন মেয়েটা কে দেখেছিল।তবে আজ সবগুলো দোলনায় ছোট বাচ্চারা বসে আছে।আরমানের বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।আর একবার হতাশ হয়ে ফিরতে নিয়ে থমকে গেল।এইতো সামনে থেকে যে আসছে তার অপেক্ষাতেই তো আরমান আছে।হ্যাঁ আরমান ভুল দেখছে না।সেই একই চেহারা।অপ্রত্যাশিতভাবে পরনের জামাটাও একই যার ফলে আরমানের চিনতে আরো সুবিধা হলো।তবে আরজুর সেসব খেয়াল নেই।আরমান কে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে ধরলে আরমান একবার ডাকলো।
“এই,এই মেয়ে দাঁড়ান।”
আরজু দাঁড়ালো,তবে নিশ্চিত হতে পারল না যে উক্ত সম্মোধনটা ওকে উদ্দেশ্য করেই করা হয়েছে কিনা।পাল্টা প্রশ্নও করল না।আরমান নিজে থেকেই বলে উঠল,
“হ্যাঁ আপনাকেই ডেকেছি।চিনতে পারছেন আমায়?”
আরজু পিছন ফিরে তাকালো।চোখে মুখে তার একরাশ প্রশ্ন সমেত বলল,
“আমাকে বলছেন?”
“হ্যাঁ আপনাকে বলছি।মনে নেই সেদিন পার্কে দেখা হয়েছিল আমাদের।আপনি বৃষ্টিতে ভিজছিলেন,আমি এসে আপনাকে বললাম চলে যেতে।মনে পড়ছে না?”
আরজু মস্তিষ্কে একটু জোর খাটাতেই সেই দিনের কথা মনে পড়লো।তবে সেইদিন আরমানের মুখটা দেখা হয়নি সেজন্য ঘটনা মনে করে বুঝলো যে এই ছেলেটা সেদিনের সেই ছেলেই।তবে আরমান কে বুঝতে দিল না যে ও চিনতে পেরেছে।ঘটনাটা মনে না পরার ভাব ধরে বলল,
“দুঃখিত মনে পড়ছে না।আর আমি বৃষ্টিতে ভিজিনি।আপনি বোধহয় অন্য কারো কথা বলছেন।”
“আরে না আমি আপনার কথাই বলছি।আর এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন কি করে?হ্যাঁ মানছি আমার মুখটা না হয় নাই মনে পড়লো তাই বলে নিজে যে বৃষ্টিতে ভিজেছিলেন সেই কথাটাও ভুলে যাবেন?না না এতটা ভুলো মন হতে পারে না।”
“বললাম তো আমি বৃষ্টিতে ভিজিনি।আপনি আমায় অন্য কারো সাথে গুলিয়ে ফেলছেন।”
কথাটা বলে আরজু চলে যেতে নিলে পিছন থেকে আরমান বলে উঠলো,
“কোন কারণে কি আমার সাথে কথা বলতে ভয় করছেন?আমি অনেক দিন থেকে আপনাকে খুঁজছি কিন্তু পাইনি।আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা তবে আমি প্রতিদিনই পার্কে আসি শুধুমাত্র আপনার সাথে কথা বলবো জন্য।সেই যে দেখা হয়েছিল তারপর আজকে আবার আপনাকে খুঁজে পেলাম।”
আরজু কাট কাট গলায় বলল,
“না আপনার আমার থেকে কিছু পাওনা আছে না আমার আপনার থেকে কিছু পাওনা আছে তবে অযথা কেন খুঁজছেন আমায়?”
“লেনাদেনা ছাড়া কি কোন সম্পর্ক তৈরি হয় না নাকি?”
“আমার জানামতে হয় না।প্রত্যেকটা সম্পর্কে কোনো না কোনো চাহিদা থাকে আমাদের।হোক সেটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক,ভাই-বোন,বাবা-মা কিংবা ভালোবাসার।কোন না কোন কিছু আমরা অপর পাশের মানুষটার থেকে চাই জন্যই সেই সম্পর্কটা তৈরি করি।”
“ভুল ভাবছেন।আমি আপনার থেকে কিছু চাই না।আমি তো শুধুই এমনি কথা বলতে চাই।”
“চাওয়া তো একটা আছেই।আপনি আমার সাথে কথা বলতে চান এখন,পরে আমার মনোযোগ চাইবেন,আমার সময়ও চাইবেন হয়তো যা আমার পক্ষে আপনাকে দেওয়া সম্ভব না।এই পার্কটা আমার শান্তির জায়গা।অযথা আমার শান্তি নষ্ট করবেন না।কেউ আমার পিছনে ঘুরুক সেটা আমার মোটেই পছন্দ না।”
আরজুর আর দোলনার কাছে যাওয়া হলো না।যে পথে এসেছিলে আবার ঘুরে সেই পথ দিয়েই চলে গেল।
আরমান কেন যেন চেয়েও আরজুর পেছনে যেতে পারলো না।আরজুর শান্তি নষ্ট করতে চায় না আরমান।আর একবার যেহেতু দেখা পাওয়া গেছে আরজুর তার মানে পরবর্তীতেও পাওয়া যাবে।আপাতত না হয় সম্পর্কের সীমাটুকু এই পার্কের গন্ডির ভেতরেই থাক।
_______
বেশ পুরনো একটা ফ্ল্যাট।দেয়ালের বেশ অনেক জায়গা থেকে রং চটে গেছে।মেঝের টাইলসটাও কেমন যেন পুরনো লাগছে দেখতে।ঘরের আসবাবপত্রগুলোও বহু পুরনো সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।মুনতাসির আরমানকে নিয়ে গিয়ে নিজের ঘরে বসালো।তিন রুমের একটা ফ্ল্যাট।দুটো বাথরুম আর রান্নাঘর।রান্নাঘরের সামনে একটু ফাঁকা জায়গা যা ডাইনিং রুম হিসেবে পরিচয় পেয়েছে তবে আলাদা করে ড্রইং রুম নেই।যার ফলে কোন অতিথি এলে সোজা নিয়ে গিয়ে নিজেদের ঘরেই বসাতে হয়।
মুনতাসির আজ খুব খুশি আরমান ওর বাড়িতে এসেছে বলে।আরমানেরও ভীষণ ভালো লাগছে এখানে এসে।কেউ যদি এতটা সম্মান আর আন্তরিকতার সাথে নিজের বাড়িতে ডাকে তবে তো ভালো লাগবেই।আর সবকিছুর ঊর্ধ্বে মুনতাসিরের মুখের হাসিটা।এই হাসি দেখলেই কেন যেন আরমানের মনটা ভালো হয়ে যায়।
আরমানকে বিছানার উপর বসিয়ে মুনতাসির ব্যস্ত গলায় বলল,
“আপনি বসুন ভাই আমি মা কে ডেকে আনছি।”
কথাটা বলে মুনতাসির পাশের ঘরে চলে গেল।কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে নিজের মা রুবিনা খাতুন আর বোন মৃন্ময়ী কে নিয়ে এলো।ওদের কে দেখে আরমান উঠে দাঁড়িয়ে রুবিনা খাতুন কে সালাম দিল।রুবিনা খাতুন সালামের জবাব দিয়ে খুশি মনে বললেন,
“তুমি যে আমার বাড়িতে এসেছো আমি খুব খুশি হয়েছি বাবা।আমার ছেলের মুখে তোমার প্রশংসা শুনে তোমাকে দেখার খুব ইচ্ছে হয়েছিল।আমি ভাবতে পারিনি যে তুমি আসবে।আগে জানলে তোমাকে আরো কবে আসতে বলতাম।”
আরমান আলতো হেসে বলল,
“আমি যদি আগে জানতাম যে আপনার আমাকে দেখার এত ইচ্ছে তাহলে মুনতাসির না বলতেই আমি নিজে থেকেই চলে আসতাম।পরবর্তীতে যদি আবার কখনো আপনার আমাকে দেখতে ইচ্ছে হয় তবে আমাকে বলবেন কেমন?এবার মুনতাসির কে আর বলাতে হবে না।আমি আপনাকে আমার নাম্বার দিয়ে যাব।”
আরমানের ব্যবহারে রুবিনা খাতুন ভীষণ সন্তুষ্ট হলেন।ছেলেটার ব্যবহার সত্যি অমায়িক।ঠিক যেমন মুনতাসির ওকে বর্ণনা দিয়েছিলো তেমনি।আরমানের সাথে উনি যেন নিজের ছেলের ভীষণ মিল খুঁজে পেলেন।শুধু ব্যবহার না চেহারাতেও তিনি অনেক মিল খুঁজে পেলেন।এইজন্যই বোধহয় তার ছেলের আরমানকে এতটা পছন্দ।
আরমান এবারে নিজের সাথে আনা রঙিন কাগজে মোড়ানো উপহারটা মৃন্ময়ীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“শুভ জন্মদিন।আসলে আমি তো জানি না তুমি কি পছন্দ করো,মুনতাসির কে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু কিছু বলেনি তাই নিজে পছন্দ করে এনেছি।তবে হ্যাঁ পরের জন্মদিন আসতে আসতে তোমার সাথে আমি বেশ ভালো একটা বন্ধুত্ব তৈরি করো নেব।তখন আমায় আর মুনতাসির কে জিজ্ঞেস করতে হবে না যে তোমার কি পছন্দ।আমি নিজে থেকেই আনতে পারব।”
মৃন্ময়ী হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,
“ধন্যবাদ ভাইয়া।আমার ভাইয়া ঠিকই বলেছে আপনি খুব ভালো,একদম আমার ভাইয়ার মতন।”
“তোমার নামটাই তো জানা হলো না।নাম কি আর কোন ক্লাসে পড়ো?”
“আমার নাম মৃন্ময়ী।পরের বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবো।”
“ও আচ্ছা। আমার ছোট ভাইয়ের থেকে একটু ছোট তুমি।কি হওয়ার ইচ্ছে?”
“ভাইয়া বলেছে ডাক্তার হতে হবে।”
“বেশ।তবে ভাইয়ার ইচ্ছে পূরণ করো।ভালো করে পড়াশোনা করো কেমন?”
আরমান এবার মুনতাসিরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“সবাই কে দেখলাম শুধু আঙ্কেল বাদে।তোমার বাবা কই মুনতাসির?”
রুবিনা খাতুন আর মৃন্ময়ীর মুখটা শুকিয়ে গেলেও মুনতাসিরের ক্ষেত্রে তেমনটা হলো না।আলতো হেসে বলল,
“আব্বা নেই ভাই।আশা করছি কবরে ভালোই আছেন।”
আরমানের মুখ থেকে হাসিটা উড়ে গেল।এই পরিবার তবে তো একা।
“কতিদন হলো?”
“অনেক বছর।”
“ওহ্।”
আরমান আর এই বিষয়ে কথা বাড়াতে চাইলো না,অন্য প্রসঙ্গ তুললো।কথাবার্তা শেষে আরমান মুনতাসির কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমি তবে এখন আসি মুনতাসির।পরিচয় তো হয়েই গেল।অন্য দিন আবার আসবো কেমন?”
“কি যে বলেন না ভাই।আপনি এসেছেন আর আপনাকে না খাওয়া দাওয়া করিয়ে আমি ছাড়বো এটা ভাবলেন কি করে?রাতে আমাদের সাথে খেয়ে তারপরে বাড়ি ফিরবেন।”
মুনতাসিরের কথায় সায় জাানিয়ে রুবিনা খাতুনও বললেন,
“হ্যাঁ বাবা এসেছো যখন আমার হাতের রান্না করা খাবার খেয়ে গেলে আমার ভালো লাগবে।”
তিনজনেই অনেক জোড়াজুড়ি করলো আরমানকে,যার ফলে আরমান আর না করতে পারলে না।এত ভালোবাসা কে অপমান করে যাওয়া ঠিক হবে না।যে কদর করছে তাকে সম্মান দিতে হয়,তার কদরের মূল্য দিতে হয় না হলে পরবর্তীতে এই সম্মানটুকু আর পাওয়া যায় না।
আরমান মাথা নাড়িয়ে সায় জানাতেই রুবিনা খাতুন আর মৃন্ময়ী গেলেন টেবিলে খাবার সাজাতে।ওদের কে সাহায্য করার জন্য মুনতাসিরও যেতো ধরলে আরমান ওকে থামালো।পিছন থেকে নাম ধরে ডাকলো।
“মুনতাসির!”
মুনতাসিরের তৎক্ষনাৎ জবাব এলো।
“জ্বী ভাই।”
আরমান মুনতাসিরের কাঁধে হাত রেখে মৃদু চিন্তিত গলাতেই বলল,
“তোমার রাজনীতিতে আসা উচিত হয়নি ছেলে।একবার ভেবে দেখেছো তোমার কিছু হয়ে গেলে এই দুজন মানুষের কি হবে?”
মুনতাসির স্বভাব সুলভ হেসে বলল,
“এত কিছু ভেবে কি আর কেউ এসবে জড়ায় ভাই?জীবনের ঝুঁকি তো আপনারও আছে।”
“আমার বাবা-মায়ের আরো দুটো সন্তান আছে আমি বাদে।একটা চঞ্চল ছেলে আছে আর একটা বুদ্ধিমতি মেয়ে আছে।আমার বাবা এখনো জীবিত আছে।আমার কিছু হয়ে গেলে ওরা সবাই মিলে নিজেদের কে সামলে নিতে পারবে।কিন্তু তোমার কিছু হয়ে গেলে তোমার দাফন কাজ সম্পন্ন করার মতনও একটা পুরুষ নেই।”
“আপনি আছেন তো ভাই।”
মুনতাসিরের কথাটা শুনে আরমান কেমন যেন চমকে উঠলো।মুনতাসিরের ওর প্রতি এতটা বিশ্বাস যেন ভেতরটা কে কেমন নাড়িয়ে তুলল।
“আমি আছি?”
“হ্যাঁ ভাই আপনি আছেন।আমি জানি একবার যখন আমার মাথায় আপনি হাত রেখেছেন সেটা আর সরাবেন না।আর এমনিতেও রাজনীতি আমার র/ক্তে মিশে আছে।এটার থেকে আমাকে দূরে রাখা সম্ভব না।”
আরমান ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
“মানে?”
“আমার বাবাও রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন ভাই।এই রাজনীতির জন্য তো উনি প্রাণটাও দিয়ে দিয়েছেন সেখানে আমি ওনার ছেলে হয়ে রাজনীতি তে না জড়িয়ে থাকি কি করে?”
আরমান এবার ধমক দিয়ে বলে উঠলো,
“চুপ করো ছেলে।দুই ফুটের বাচ্চা হয়ে আমায় জ্ঞান দিচ্ছে।শোনো ছেলে,কোনো বিষয়ে জড়াতে গেলে আগে তার মন্দ দিকটা দেখতে হয়।কেননা মন্দটুকু সেই বিষয়ের ভালো দিকটাকে তোমায় উপভোগ করতে দেবে না।বোঝো না তো কিছুই আবার এসেছো রাজনীতি করতে।”
মুনতাসির আবারো হেসে বলল,
“কি ভুল করেছি আপনি ঠিক করে দিন ভাই।”
“যা বলছি চুপচাপ শোনো হামিদের সাথে কোনো প্রকার তর্কে বা ঝামেলায় জড়াবে না।কখনো খারাপ কিছু আঁচ করতে পারলে আমায় জানাবে।”
“আচ্ছা।”
“আরেকটা কথা,রাজনীতি নিয়ে তোমায় বেশিদূর যেতে হবে না।ভার্সিটি অব্দি সীমাবদ্ধ রাখো এটা কে।পড়াশোনায় ভালো তুমি,একটা ভালো চাকরি খুঁজে শান্তি তে থাকবে।এসব আজেবাজে কাজের মাঝে থাকতে হবে না।”
“কিন্তু ভাই….”
মুনতাসির কে নিজের কথা শেষ করতে না দিয়েই আরমান আবারো ধমক দিয়ে বলল,
“একদম বেয়াদবি করবে না আমার সাথে।এতটাও বড় হয়ে যাওনি যে আমার কথার অবাধ্যতা করবে।ছোট ভাই আমার আরেকটা আছে যে এখনো আমার হাতে মার খায়।বেশি কথা বললে তোমাকেও কিন্তু ছাড় দেব না।”
“একবার যখন জড়িয়েই পড়েছি তখন ছেড়ে দিলেই কি এসবের সমাপ্তি হবে ভাই?”
আরমান জানে মুনতাসিরের কথা শতভাগ সত্য।রাজনীতির ময়দানে তৈরা হওয়া শত্রুরা কখনোই ভালো থাকতে দেবে না।বরং সুযোগ খুঁজে বেরাবে প্রতিশোধ নেওয়ার।
আরমান কে চিন্তার মাঝে ডুবে থাকতে দেখে মুনতাসির আশ্বস্ত করে বলল,
“এত ভাববেন না ভাই।আমার কিছু হবে না ইনশাআল্লাহ।আমি তো আপনাকেই অনুসরণ করি।”
আরমান নির্জীব হেসে বলল,
“মুনতাসির,তুমি এমন একজন কে অনুসরণ করে বাঁচতে চাইছো যার শত্রুরা একটা ছোট্ট সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছে তার মৃতদেহ নিয়ে উৎসব করবে বলে।আর সেই উৎসবের আয়োজক হবে আমার র/ক্তের সম্পর্কের কিছু মানুষ।"
চলমান।

No comments