Header Ads

তোর পিরীতে পাগল হইলাম রে

 তোর পিরীতে পাগল হইলাম রে 

পর্ব_৩


সকাল সকাল ভার্সিটিতে প্রবেশ করলো আরমান।বাইকের শব্দ পেতেই মাঠের শিশির ভেজা ঘাসের উপরে বসে থাকা শিক্ষার্থীদের একবার নজর পড়লো তার ওপর।
অনাকাঙ্খিতভাবে সবার মনোযোগ কেড়ে নিলো আরমান।ছেলেরা অবশ্য খুব তাড়াতাড়ি নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিল তবে মেয়েরা নিজেদের দৃষ্টি সরাতে পারলো না।আরমানের নিজেকে নিয়ে একটা ব্যাপারে ভীষণ গর্ব হয় আর তা হলো কোন মেয়ে একবার ওর দিকে তাকালে তৎক্ষণাত নিজের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরানোর ক্ষমতা থাকেনা।
হ্যাঁ এটাই আরমানের গর্ব।আরমানের মতে মেয়েদের মনোযোগ পাওয়াটা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ব্যাপারগুলোর একটা,যেটা সবাই পায় না।
বাইক নিয়ে গিয়ে মাঠের এক পাশে দাঁড় করালো।এই ঠান্ডার দিনে নিজেকে ঠান্ডা থেকে বাঁচানোর জন্য পাঞ্জাবির ওপরে একটা শাল জড়িয়েছে আরমান।সাদা পাঞ্জাবির উপরে ছাই রঙা শালটা বেশ মানিয়েছে।বাইক থেকে নামতে নিয়ে কাঁধের উপর থেকে শালটা পড়ে গেল।আরমান আলগোছে এক হাতের সাহায্যে শালটা আবারো সেই কাঁধের উপরে তুলে দিল।মূহুর্তের মাঝে কয়েকজন যুবক আরমান কে ঘিরে দাঁড়ালো।সবার মুখেই হাসি।সবাই একসঙ্গে সালাম ঠুকলো।আরমান আলতো হেসে সালামের জবাব দিলো।চোখেমুখে তার আজ একটু বেশিই হাসি দেখা যাচ্ছে।এত কাজের মাঝেও তার চেহারার লাবণ্য একটু কমেনি।ধবধবে ফর্সা ত্বকের ওপর খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি,তীক্ষ্ম চোয়াল,ঘন ভ্রুঁ জোড়া।কালো মণি যুক্ত গভীর চোখ দুটোতে যেন কি এক অদ্ভুত রহস্য লুকিয়ে আছে।বা এমনও হতে পারে যে সেই চোখের ভাষাটা পড়া হয়ত খুবই সহজ তবে সবার জন্য না।তবে আরমান হাসলে সেই জটিল চোখ দুটো দেখতে ভীষণ নিষ্পাপ লাগে।মনে হয় কোন রহস্য,কোন জটিলতা লুকিয়ে নেই ওখানে।আছে কেবল অপর পাশের মানুষটাকে মাতাল করে তোলার জন্য ভয়ঙ্কর কোনো নেশা দ্রব্য।ঠোঁট দুটো সিগারেটের ছোঁয়া পেতে পেতে হালকা কালচে বর্ণ ধারণ করেছে।তবে যখন গালে হালকা টোল পরে তখন সেই কালচে ঠোঁট দুটো দেখতেও আর খারাপ লাগে না।এত পরিপাটি সাজসজ্জার মাঝেও বড় হয়ে যাওয়া চুলগুলো দেখতে একটু অগোছালো লাগছে ঠিকই তবে ছেলেটার সৌন্দর্য কমাতে পারেনি।আরমান হাতের সিলভার ডায়ালের ঘড়িটায় চোখ বুলিয়ে একবার সময়টা দেখে নিল।একদম ঠিক সময়েই এসেছে।হাতের সাহায্যে অযত্নে বড় হওয়া চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।ওর অনুসারী হিসেবে পেছন পেছন ছেলেগুলোও আসলো।
আরমান সোজা অডিটরিয়ামে ঢুকলো।আজ সকাল সকালই চলে এসেছে ভাষণ দেওয়ার জন্য।যদিও হাতে এখনো সময় আছে।তবে আরমান কাজের জায়গায় দেরিতে পৌঁছানোর থেকে সময়ের আগে পৌঁছাতেই বেশি পছন্দ করে।অডিটোরিয়ামটা তখনও ফাঁকাই।আরমান ভেতরে গিয়ে একটা চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসলো।ওর সঙ্গে আসা ওর দলের ছেলেগুলো আরমানের পাশে বসলো না।
দলের একটা ছেলে আগবাড়িয়ে আরমান কে একটু খুশি করার জন্য বলল,


“ভাই চা খাবেন?একটু চা আনি?ভাষণ দেওয়ার সময় তাহলে গলাটা পরিষ্কার থাকবে।”
আরমান পকেট থেকে ফোনটা বের করতে করতে ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“প্রয়োজন নেই।”
ছেলেটা থেমে গেল।এবার অন্যজন আরো একটু খাতির দেখিয়ে বলল,
“ভাই নাস্তা করে এসেছেন তো সকালে নাকি নাস্তার ব্যবস্থা করব?”
“না দরকার নেই।আমি খেয়ে এসেছি।তোরা খেয়েছিস?”
“হ্যাঁ ভাই খেয়েছি।”
“কোন ঝামেলা হয়েছে নাকি?তোদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলবি?”
ছেলেগুলো বোধহয় সত্যি কিছু বলতে চাইছে আরমান কে।তবে সাহস করে বলে উঠতে পারছে না।ওদেরকে একজন আরেকজনের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে দেখে আরমান ফোনটা পকেটে রেখে চোখ তুলে ওদের দিকে তাকালো।আরমান কে তাকাতে দেখেই সবাই চাওয়াচাওয়ি থামিয়ে একদম সোজা হয়ে দাঁড়ালো।আরমান কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল, 
“কি সমস্যা?”


একটা ছেলে সাহস করে বলল,
“ভাই মুনতাসির আরেফীন আছে না?”
“হ্যাঁ আছে।তো কি হয়েছে?”
“আসলে হয়েছেটা কি ওর দলের লোকজন বলাবলি করছে ওর নাকি জনপ্রিয়তা বেশি জন্য আপনি ওর সাথে ভালো ব্যবহার করে চলেন।মানে আপনি ওকে হাতে রাখতে চাইছেন এই আর কি।”
আরমান ব্যাঙ্গাত্মক হেসে বলল, 
“সত্যি?” 
“হ্যাঁ ভাই।সাথে এটাও বলাবলি করছে যে ওই মুনতাসির যদি আপনার বিপক্ষে দাঁড়াতো তাহলে নাকি আপনি জিততে পারতেন না।কিন্তু ও আপনাকে সম্মান করে বলে আপনার অসম্মান যেন না হয় সেজন্য সহ সভাপতি পদের জন্য লড়ছে।”
“আর তোরা সে সব শুনে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিস নাকি?”
“না ভাই তেমন কোন ব্যাপার না।আসলে আপনি তো কোন প্রকারের ঝামেলা করতে নিষেধ করে দিয়েছেন।আর ওরা বারবার সেই সুযোগটা নিয়ে আমাদেরকে খ্যাপানোর চেষ্টা করছে।আপনি অনুমতি দিন,সবকটার মুখ বন্ধ করে দেব।”
আরমানের মুখ থেকে হাসিটা হারিয়ে গেল।চোখে মুখে তার কাঠিন্য ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল,
“নিষেধ করেছি তোদের এসব ঝামেলা করতে।রাজনীতি মানেই যে ঝামেলা করতে হবে এই ধারণাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।আমি শান্তি প্রিয় মানুষ।এসব ঝামেলা আমার পছন্দ না।মুনতাসিরের সাথে তো কোনমতেই না।যেখানে দেখবি ঝামেলা ছাড়া টেকা যাচ্ছে না সেখানে সোজা মুখ বন্ধ করে দিবি।কিন্তু এই রোজ রোজ টুকটাক মা/রা/মা/রি আমার পছন্দ না।"
পাশ থেকে অন্য একটা ছেলে বলে উঠলো,
“ভাই আমার ওই মুনতাসিরের এত ভালো মানুষি ঠিক সুবিধার লাগেনা।আপনার সাথে তো বেশ ভালো ব্যবহার করে তাহলে ওর দলের ছেলেপেলে কেন এমন কথা বলবে?আমার মনে হয় ও আপনাকে হাতে রেখে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়াচ্ছে।”
আরমান চেয়ারে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে বলল, 
“রাজনীতির প্যাঁচ তোরা এখনো বুঝে উঠতে পারিসনি।ঝামেলা করছে একজন আর নাম হচ্ছে অন্যজনের।শোন,কেউ কাউকে হাতে রেখে জনপ্রিয়তা বাড়াতে পারে না।জনপ্রিয়তা বাড়ে তার কর্মে।যেভাবে আমি জনপ্রিয়তা পেয়েছি ঠিক একই ভাবে মুনতাসিরও জনপ্রিয়তা পেয়েছে।ছেলেটাকে আমার বেশ ভালো লাগে।ও আমার থেকেও অল্প সময়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।আর আমি মানুষ চিনি।এই রাজনীতিতে আসার আমার যে উদ্দেশ্য মুনতাসিরেরও ঠিক সেই একই উদ্দেশ্য।যদি ও আমার প্রতিপক্ষ হয় এবং আমার থেকে অধিক যোগ্য হয় তবে আমি চাই ও যেন জেতে।তখন আমার হারের মাঝেও একটা স্বস্তি থাকবে।”


ছেলেগুলো আর কিছু বলার সাহস পেল না।আরমান ঘড়িতে একবার সময় দেখে নিল।
এখনো বেশ অনেকটা সময় বাকি আছে।
এখন আরমানের মনে হচ্ছে ও বোধহয় একটু বেশিই তাড়াতাড়ি এসে গেছে।এত তাড়াহুড়ো করে ঘুম থেকে না উঠলেই হতো,আরো কিছুক্ষণ ঘুমোনো যেত।তবে এখন তার সামনে এত জটলা ঠিক ভালো লাগছে না।সারাক্ষণ যে ছেলেগুলো কেন ওকে এভাবে ঘিরে রাখে আরমান ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।মৃদু বিরক্তিকর গলায় বলল,
“তোরা এখন যা তো।এত ভিড়ভাট্টা ভালো লাগছে না।”
বাধ্য ছেলের মতন তারা আরো একবার আরমানকে সালাম দিয়ে সেখান থেকে এক এক করে চলে গেল।
এবারে যেন আরমান একটু শান্তি পেল।গায়ে হাওয়া লাগছে এখন।তবে কিছুক্ষণের মাঝে আরো একটা সালাম আরমানের কানে এলো।এবারে আরমান বিরক্ত হলো না।চেয়ারে এলিয়ে দেওয়া মাথাটা সোজা করে বসলো।কন্ঠটাও নরম হলো।
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।এসো মুনতাসির।আমার পাশের চেয়ারটায় বসো।”
গাঢ় জাম রঙের পাঞ্জাবি পড়েছে মুনতাসির।ছেলেটা দেখতে বেশ সুদর্শন।গোলগাল মুখের সাথে চোখা একটা নাক।একদম মেয়েদের মত গোলাপী ঠোঁট।চুলগুলো সব সময় এলোমেলো থাকে।তার কারণ পাঞ্জাবির সাথে অধিকাংশ সময়ই সে টুপি পড়ে।এখনও তার ব্যতিক্রম হলো না।তবে মুনতাসির পাতলা টুপিটা মাথা থেকে খুলে পাঞ্জাবির পকেটে রাখলো।ফর্সা গালে এক আঙুল সমান দাঁড়ি।
ছেলেটার মুখে সবসময় একটা হাসি থাকে।আজ অব্দি আরমান কখনো ওই মুখে কোন কাঠিন্যতা,রাগ বা গম্ভীর ভাব দেখেনি।সবার সাথে বেশ সুন্দর হাসি হাসি মুখে কথা বলে।মূলত মুনতাসিরের ব্যবহারটার জন্যই এত তাড়াতাড়ি বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে।মোটকথা মুনতাসিরের মুখটা দেখলেই কেমন যেন একটা শান্তি অনুভব করা যায়।হাসলে যেন নুর ঝরে।
মুনতাসির আরমানের পাশে একটা চেয়ার টেনে বসলো।আরমান একটু ঝুঁকে এসে হাতের সাহায্যে মুনতাসিরের চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বলল,


“এবার ঠিক আছে।মাশাআল্লাহ,এখন দেখতে আরো সুন্দর লাগছে তোমায়।”
মুনতাসির আলতো হেসে বলল, 
“কেমন আছেন ভাই?”
“আমি ভালো আছি।তুমি কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।”
“তা এখানে হঠাৎ?কোন দরকার ছিল আমার সাথে?”
“আপনি তো আজ ভাষণ দেবেন,শুনতে এলাম সেসব।আপনি কি বলেন,কি করবেন,পরিকল্পনা কি সেসবই শুনতে এলাম আরকি।”
“তুমি কি ভুলে যাচ্ছে মুনতাসির যে আমি তোমার প্রতিপক্ষ দলের?”
“মানছি আপনি আমার প্রতিপক্ষ দলের তবে এসব রাজনীতি,নির্বাচনের বিষয়গুলোতে আমি আগ্রহ খুঁজে পেয়েছি আপনাকে দেখে।আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে আমি আপনাকে অনুসরণ করি?” 
আরমান হেসে উঠে বলল,
“আমি আবার অনুসরণ করার মতন কোন মানুষ হলাম নাকি?না আমি তেমন কোন বড় রাজনীতিবিদ,না আমার খুব বেশি নাম ডাক আছে।আমাকে অনুসরণ করো না।আমার থেকে বড় কোন রাজনীতিবিদ কে অনুসরণ করো।”
“আপনি যেমনই হন না কেন এসবের মাঝে আমার আসাই আপনাকে দেখে।আমি জানি আপনি হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করবেন না কিন্তু আমার কাছে আপনি একজন চমৎকার ব্যক্তিত্ব।আমি জানিনা আমি আপনার মতন হতে পারব কিনা তবে আমি চেষ্টা করি আপনার মতন হওয়ার।এই নির্বাচনে আমি আপনার প্রতিপক্ষ দলের ঠিকই তবে বিশ্বাস করুন আমি চাই আপনি জিতুন।কারণ আমি জানি আমাদের দুজনের লক্ষ্য এক।যদি আপনি জেতেন তবে শিক্ষার্থীদের কথা ভাববেন কিন্তু যদি অন্য কেউ জেতে তবে তারা ভাববে শুধুমাত্র নিজেদের কথা।”
আরমান এবার সোজা হয়ে বসলো।মুনতাসিরের কাঁধে হাত রেখে বলল, 
“সবার তোমার প্রতি অনেক আশা মুনতাসির।এখন এই ছোট পরিসরে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছো,ভবিষ্যতে হয়তো আরো বড় পদে দাঁড়াবে।মেয়র,এমপি তারপরে হয়তো ধীরে ধীরে মন্ত্রীর দিকে যাবে।একটা কথা সবসময় মাথায় রাখবে জনগণের আমাদের প্রতি অনেক আশা।রাজনীতিবিদ নিয়ে মানুষের মনে খুব ঘৃণিত একটা ধারণা আছে।আর এটা সারা জীবন থাকবে আমি সেসব জানি।কেননা অন্যদেরকে আমরা বদলাতে পারবো না।তাই আমাদের চেষ্টা করতে হবে নিজেদেরকে বদলানোর,নিজেদেরকে ঠিক পথে রাখার।এখন যেই নীতিতে চলছো সেই নীতি সারা জীবন অবলম্বন করো।তবে আমিও গর্ব করে বলতে পারব হ্যাঁ কেউ আমায় দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এখনো সৎ পথেই রাজনীতির মাঠে রাজ করে বেড়াচ্ছে।”
মুনতাসিরের কাঁধে থাকা আরমানের হাতের উপর মুনতাসির পাল্টা হাত রেখে আশ্বস্ত করে বলল,
“কথা দিচ্ছি আপনাকে সারাজীবন এই নীতিতেই বাঁচবো।যদি কখনো আমার আরো বড় জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হয় তখনও জনগণের ভরসা আমি হারাতে দেবো না।”


______
ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে আরজুর দুপুর পার হয়ে গেল।হোস্টেলে পৌঁছাতে পৌঁছতে আরো এক ঘন্টার মতন সময় লাগলো।হোস্টেলে ঠিকমতো পৌঁছেছে ঠিকই তবে কেন যেন শান্তি পাচ্ছে না।মনের মাঝে একটা অস্থিরতা কাজ করছে।এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়ির সবাই জেনে গেছে যে আরজু বাড়িতে নেই।নিশ্চয় অশান্তিও শুরু করেছে।কে জানে প্রার্থনা আর ওর মায়ের কি হলো?আদৌও ওরা ঠিক আছে কিনা সেটাও জানে না।ওর বাবা আর ভাই থাকতে ভালো থাকার কথাও না।অমানুষগুলো না জানি কি অত্যাচার করছে।
এতসব চিন্তা নিয়ে আর কিছুই ভালো লাগছে না।কেন যেন নিজেকে স্বার্থপর মনে হচ্ছে।মনে হচ্ছে নিজের সংগ্রাম গুলো সত্যি করার জন্য ওর আপাকে বিপদের মাঝে ফেলে রেখে এলো।যদি ওরা কিছু খারাপ করে ফেলে প্রার্থনার সাথে!
আর ভাবতে পারল না আরজু।বোরকাটা খুলে গোসল করতে গেল।নাসিমা বলেছিল যেখানে থাকে সেই ঠিকানাও যেন বদলায় কাউকে কিছু না বলে,আর সেটাও খুব তাড়াতাড়ি।আরজু জানে ফিরোজ পা/গল কুকুরের মতন ওর খোঁজ করবে।আর ওকে সাহায্যে করবে আরজুর নিজেরই মায়ের পেটের ভাই যাদের শরীরে একই র/ক্ত বইছে।কিন্তু এখন এত তাড়াতাড়ি অন্য জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করবে কি করে?বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকার মতন সামর্থ নেই আরজুর,কোনো মেসেই উঠতে হবে।পরিচিতও তো কেউ নেই যাকে একটু সাহায্য করতে বলবে।হাতেগোনা দু একটা মানুষের সাথেই তো কথা হয়।অনেক ভাবনা চিন্তা করে নিজের এক বান্ধবীকে কল করল।আগে একসাথে একই হোস্টেলে থাকতো কিন্তু কয়েক মাস হল নুসরাত অন্য জায়গায় গিয়েছে।ওর থেকে শোনা যাক যে কোন থাকার ব্যবস্থা করতে পারে কিনা।
আরজু ফোন দিলো নুসরাতের নাম্বারে কিন্তু নুসরাত জানালো যে ওখানে কোন সিট ফাঁকা নেই।তবে আশ্বস্ত করেছে থাকার জায়গা ফাঁকা হলে সঙ্গে সঙ্গে আরজু কে জানাবে।
হতাশা আর একরাশ চিন্তা সমেত আরজু ফোনটা কেটে দিল।আর কাকে ফোন দেওয়া যায় সেসব ভাবতে লাগলো।অনেক ভাবনা চিন্তা করে আরো একটা মানুষের কথা মনে পড়ল আরজুর যে বলেছিল যদি কখনো কোন দরকার হয় তাহলে যেন তার সাথে আরজু যোগাযোগ করে।


কিন্তু আরজুর কেন যেন তারপরেও ফোন দিতে অস্বস্তি হচ্ছে।হ্যাঁ মানছে সেই মানুষটা বলেছিল সাহায্য করবে।তাই বলে এভাবে হঠাৎ করে কি সাহায্য চাওয়াটা ঠিক হবে? এমন তো না যে আরজুর খুব ভালো সম্পর্ক বা ওর সাথে রোজ কথা বলে।বরং যে দুই একবার কথা হয়েছে ওই মানুষটাই আগে এসে কথা বলেছে।আরজু কখনো নিজ থেকে খোঁজ নেয়নি।আর আজ সরাসরি সাহায্যের জন্য কল করবে?
অনেক ভাবলো আরজু।ভাবনা শেষে ঠিক করল না কল করবেই।বিপদে পড়েছে জন্যই তো সাহায্য চাইছে এমনিতে তো আর চাইতো না।
কল করলো সেই মানুষটার নাম্বারে।প্রথমবার রিং হয়ে গেলে কিন্তু অপর পাশ থেকে রিসিভ করলো না ফোনটা।আরজু আর কল দেওয়ার সাহস পেল না।ভাবলো হয়তো ব্যস্ত আছে।নিশ্চয়ই আরজুর ফোনের থেকেও কোন দরকারী কাজে আছে বলে ফোনটা রিসিভ করছে না।তবে এক মিনিট পার না হতেই আরজুর ফোনে সেই নাম্বারটা থেকে কল ব্যাক এলো।আরজু ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে সালাম দেবে তার আগেই অপর পাশ থেকে মুনতাসিরের হাস্যজ্জ্বল কণ্ঠ ভেসে এলো।
“আসসালামু আলাইকুম।কেমন আছো আরজু?”
মুনতাসির যে আরজুর নাম্বারটা চিনতে পারবে এটা আশা করেনি আরজু।হ্যাঁ আরজুর থেকে নিয়েছিল ওর নাম্বারটা তাই বলে মুনতাসিরের মতন এমন ব্যস্ত মানুষ যে এই ব্যস্ততার মাঝে আরজুর নাম্বারটা সেভ করে রাখবে,আবার কল ব্যাক করে চিনতে পারবে এটা আরজু আশা করেনি।
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।তোমার কি কোন সাহায্য প্রয়োজন?আসলে এটা বললাম তার কারণ আমি জানি কোন বিপদে না পড়লে তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করবে না।”
আরজুর এবারে সত্যি নিজেকে স্বার্থপর মনে হলো।নিশ্চয়ই মুনতাসির ওকে স্বার্থপর ভাবছে।পরবর্তী কথাটা মুখ দিয়ে বের হতে চাইলে না আর।আরজুর নীরবতার কারণটা বুঝতে পারলো মুনতাসির।নিজ থেকে বলে উঠলো,
“তুমি ভেবোনা আমি তোমায় স্বার্থপর ভাবছি।তুমি তো কারো সাথে তেমন কথাই বলো না,সেখানে আমি তো একটা ছেলে।সেজন্য এভাবে বললাম।আমি জানি অযথা কথা বাড়ানোর মেয়ে তুমি না।”
আরজু এবার একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যাক মুনতাসির ভুল বোঝেনি।


“আসলে বলছিলাম যে ভার্সিটির হলে কি আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?”
“হঠাৎ ভার্সিটির হলে কেন?যেখানে থাকছো ওখানে কি কোন সমস্যা হয়েছে?” 
“না এখানে কোন সমস্যা হয়নি।আসলে আমি এই জায়গাটা বদলাতে চাই।তাই বলছিলাম যে আপনি কি একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন ভার্সিটির হলে থাকার?”
“আচ্ছা ঠিক আছে আমি চেষ্টা করছি।যদিও আমার মনে হয় না এখন ওখানে থাকার ব্যবস্থা করতে পারবো।”
শেষ আশার আলোটাও যেন নিভে গেল।আরজু হতাশ গলায় বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে ধন্যবাদ।আপনি চেষ্টা করতে চেয়েছেন আমার জন্য এটাই অনেক।” 
“আচ্ছা আমি যদি তোমার অন্য কোন হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারি তাহলে হবে?আমার কাজিন যেখানে থাকে আমি ওখানে কথা বলে দেখতে পারি।ভার্সিটি থেকে ওটা কাছে হবে,যাতায়াতেও তোমার সুবিধা হবে।”
আরজু তড়িঘড়ি করে বলল,
“হ্যাঁ নিশ্চয়ই।কোথাও একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারলেই হবে।আর হ্যাঁ শুধু একটু দেখবেন টাকাটা যেন কম লাগে।আসলে আমি খুব বেশি টাকা এফোর্ড করতে পারবো না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে তুমি চিন্তা করো না।আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করে তোমাকে বলছি।তোমার কি খুব বেশি তাড়া আছে?কবে শিফট হতে চাইছো?” 
“দুদিনের মধ্যে হলে ভালো হয়।আমি দুদিনের মাঝে আমার সবকিছু গুছিয়ে নেব।” 
“আচ্ছা ঠিক আছে আমি দেখছি।” 
আরজু কৃতজ্ঞতার কন্ঠে বলল,
“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।আপনার এই ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারব না।আপনি ভাবতেও পারবেন না আমার ঠিক কত বড় উপকার করলেন,আমাকে কত বড় একটা অনাগত বিপদের হাত থেকে বাঁচালেন।কখনো যদি আমি আপনার কোন কাজে সাহায্য করতে পারি তবে নিশ্চয়ই বলবেন।আপনার এই ঋণ আমি শোধ করার চেষ্টা করব।”
মুনতাসির আলতা হেসে ছোট্ট করে বলল,
“মোস্ট ওয়েলকাম।”


_______
প্রায় এক ঘন্টা হলো পার্কের বেঞ্চের ওপর বসে আছে আরমান।সকালে যেমন দেখতে তাকে একদমই নেতা নেতা লাগছিলো এখন ঠিক তার বিপরীত লাগছে।শার্ট প্যান্ট পড়ে দেখতে খুবই সাধারণ একটা মানুষ মনে হচ্ছে তাকে।সেই যে মেয়েটাকে দেখেছিল তার পরে আর দেখাই পেল না।মেয়েটা তো বলেছিল যে এটা নাকি ওর রোজকার আসার জায়গা তবে আর আসে না কেন?নাকি আরমানই খুঁজে পায় না।আচ্ছা আরমান আবার চিনতে পারছে না এমনটা তো নয়?হয়তো আরজু প্রতিদিনই আসছে,ওর সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে কিন্তু আরমান চিনতে পারছে না।
কথাটা মাথায় আসতেই আরমান চোখ দুটো বন্ধ করে সেদিনের সেই মুখটা আবারও মনে করার চেষ্টা করল।এই তো আরমানের স্পষ্ট মনে আছে মুখটা।তাহলে ওকে দেখে চিনতে পারবে না কেন?এদিকে শীতের দিন হওয়ায় একটু তাড়াতাড়ি সূর্যটা ডুবে গেল।চারিদিক কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।আরো আধা ঘন্টার মতন আরমান বসে থাকলো তবে এবারে আশা ছেড়ে দিল।ভাবলো আজও বোধ হয় আরজু আসবে না।আজ আবারো এক বুক হতাশা নিয়ে বেরিয়ে গেল পার্ক থেকে আরমান।আরমান পিছনের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে গেলো আর ঠিক সেই সময়ে পার্কের সামনের গেটটা দিয়ে ভিতরে এলো আরজু।যেই বেঞ্চের উপরে এতক্ষণ আরমান বসে ছিল আরজু সেখানেই বসলো।অনেকগুলো দিন পর আবার নিজের পছন্দের জায়গাটায় এলো।আরজু জানেনা এই জায়গাটায় এলে কেন এত শান্তি পায়।তবে হ্যাঁ খুব ভালো লাগে।নিজের সাথে একটু একাকী সময় কাটাতে তার খুব ভালো লাগে।আরজুর বন্ধু-বান্ধব ভালো লাগেনা।কারো সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় না,কাউকে বিশ্বাস করে উঠতে পারে না।মানুষকে নিয়ে যে ভীষণ অবিশ্বাস আরজুর মনে।
আরজুর ধ্যান ভাঙল ফোনে মেসেজ আসার শব্দে।ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল মুনতাসির মেসেজ করেছে।একটা ঠিকানা পাঠিয়েছে, হোস্টেলের ঠিকানা।পরপর আরেকটা মেসেজ পাঠালো মুনতাসির।
“তোমার থাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছি।তুমি চাইলে কালকেই শিফট করতে পারো।


ভার্সিটি থেকে খুব কাছে।”
মেসেজটা দেখার সাথে সাথে আরজু উঠে দাঁড়ালো।যেহেতু মুনতাসির বলছে চাইলে কালই শিফট করতে পারে তাহলে কালকেই চলে যাওয়া ভালো।হোস্টেলে তো তেমন কোন জিনিস নেই আরজুর।ওই তো কয়েকটা বই খাতা আর জামাকাপড়।ওগুলো গোছাতে আর কত সময় লাগবে।
আর দেরি না করে আরজু যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো তখনই আরমান পুনরায় সেখানে এলো।বাইকের চাবিটা খুঁজে পাচ্ছে না।খুঁজতে খুঁজতে পেলো আরমান বাইকের চাবিটা।বেঞ্চের একটা কোনার দিকে পড়ে আছে।কাঙ্খিত চাবিটা হাতে নিয়ে আরো একবার আশেপাশে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিলো যে কোথাও আরজু কে দেখা যাচ্ছে কিনা।আরজু কে গেটের দিকে চলে যেতে দেখা গেল কিন্তু আরমান পিছন থেকে দেখে চিনতে পারল না।আরো একবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের পথে পা বাড়ালো আরমান আর আরজু নিজের পথে।
চলমান।

No comments

Theme images by rion819. Powered by Blogger.